Oily Skin বা তৈলাক্ত ত্বক; অনেকের কাছে যেন মূর্তমান আতঙ্কের নাম। আর তা হবে নাই বা কেন! যারা তৈলাক্ত ত্বকের সমস্যায় ভোগেন তারই বোঝেন এর কতটা যন্ত্রণা। যতই যত্ন করা হোক না কেন সময়ে অসময়ে ত্বক আবারো হয়ে পড়ে তেলতেলে ও চিটচিটে। এর উপর মড়ার উপর খাড়ার ঘা হিসেবে আসে তৈলাক্ত ত্বকে ধূলা-ময়লা আটকে যাওয়ার ব্যাপারটা। আমাদের ত্বকে থাকে অসংখ্য লোমকূপ। যাদের মাত্রাতিরিক্ত তৈলাক্ততার সমস্যা আছে, ধূলাবালির সংস্পর্শে গেলে তাদের ত্বকের এসব ছোট ছোট ছিদ্র বা Micropores বন্ধ হয়ে যায়।
এতেই তৈরি হয় নানান ধরণের ঝামেলা। এগুলোর মধ্যে প্রাথমিক পর্যায়ের সমস্যা হলো ব্রণ। তাছাড়া ব্যাকটেরিয়াল সংক্রমনের ঝুঁকিও থেকে যায়। হোয়াইট হেড মূলত ত্বকের অতিরিক্ত তেল আর মৃত কোষ মিলে তৈরি হয়। অক্সিজেনের সংস্পর্শে কিংবা চুলের Follicle Ceratinocite এর কারণে এটি কখনো কখনো পরিণত হয় ব্ল্যক হেডে। এতক্ষণ তো তৈলাক্ত ত্বকের সমস্যা নিয়ে অনেক তাত্ত্বিক কথা বলা হলো। কিন্তু ত্বকের এই তৈলাক্ত হওয়ার কারণটা কী? মুখের ত্বক তৈলাক্ত কেন হয়? মুখের তৈলাক্ততা দূর করার উপায় কি? চলুন জেনে নেওয়া যাক।
মুখের ত্বক তৈলাক্ত কেন হয়?
আমাদের ত্বককে তৈলাক্তকারী তেলের খনি হলো আমাদের ত্বকে থাকা সিবেসিয়াস গ্রন্থি। এটি থাকে আমাদের লোমকূপের গোড়ার দিকে। এটি আমাদের শরীরের মেদ বা চর্বি থেকে সেবাম (Sebum) বা তেল তৈরি করে যাতে আমাদের ত্বক প্রাকৃতিকভাবে আর্দ্র থাকে। গরমের সময় এই প্রক্রিয়াটি আরো ত্বরান্বিত হয়। ঘামের সাথে মিলে ত্বক হয়ে ওঠে আরো তৈলাক্ত। ফলে স্বাভাবিকভাবেই ব্যাপারটি খুবই অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

মুখের তৈলাক্ততা দূর করার উপায় কি?
কথায় আছে, খুঁজতে জানলে পাওয়া সহজ। মুখের তৈলাক্ততা দূর করার ব্যাপারটাকেও কিছুটা এটার সাথে রিলেট করা যেতে পারে। তৈলাক্ততার সমস্যা দূর করতে খুব দামি দামি ফেস ওয়াশ বা ফেসক্রিম ব্যবহার করার প্রয়োজন নেই। আপনি খুব সহজেই কিছু কৌশল অবলম্বন করে এবং ঘরোয়াভাবে কিছু ফেসপ্যাক তৈরি করে এই সমস্যা দূর করতে পারেন। তবে মূল কথা শুরু করার আগে কিছু প্রাসঙ্গিক কথা বলে রাখি।
ত্বকের তৈলাক্ততাকে কিন্তু শুধুমাত্র একটা উটকো ঝামেলা বলে উড়িয়ে দেওয়ার সুযোগ নেই। এরও রয়েছে বেশ কিছু ভালো দিক; বরং প্রয়োজনীয় দিক। এটি প্রাকৃতিকভাবে আপনার ত্বককে ময়েশ্চারাইজড রেখে ত্বককে শুষ্কতা থেকে রক্ষা করে। এছাড়াও এতে থাকে Vitamin-E যা ফ্রি রেডিকেলের সাথে লড়াই করে এবং প্রাকৃতিক সানস্ক্রিম ও অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট হিসেবে কাজ করে। ফলে আপনার ত্বক সূর্যের আলো এবং বায়ূদূষণের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে রক্ষা পায়।
আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়ার ত্বক বিশেষজ্ঞ আইভি লী তার এক প্রতিবেদনে বলেন যে তৈলাক্ত ত্বকে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বলিরেখা কম দেখা যায়। তাই আমাদের পরামর্শ হলো, যদি আপনার ত্বকের তৈলাক্ততার সমস্যা মাত্রাতিরিক্ত না হয় তাহলে এটি নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামানোর দরকার নেই। আর যদি মাত্রাতিরিক্ত হয় তাহলেও দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই। শেষ পর্যন্ত আমাদের সাথেই থাকুন এবং শিখে নিন এই সমস্যা ওভারকাম করার দূর্দান্ত কিছু টেকনিক। তো চলুন, মূল আলোচনায় প্রবেশ করি-
অতিরিক্ত মুখ ধোবেন না
আমরা অনেকেই, বিশেষ করে গরমের সময়, ত্বকের তৈলাক্ততার ঝামেলা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য বারবার মুখ ধুতে থাকি। এতে সাময়িক স্বস্তি পাওয়া যায় ঠিক কিন্তু এতে আপনার ত্বকের উপর প্রাকৃতিক তেলের পরিমাণ কমে যায় এবং সিবেসিয়াস গ্রন্থি আরো বেশি তেল উৎপাদন করে। খুব বেশি মুখ না ধুয়ে মাঝে মাঝে মুখ মুছে নিতে পারেন।
ব্লটিং পেপার ব্যবহার করতে পারেন
ব্লটিং পেপারের রয়েছে উচ্চ শোষণ ক্ষমতা। এটি খুব সহজেই আপনার ত্বকের অতিরিক্ত তেল শোষণ করে নিতে পারে। তাই তৈলাক্ত ত্বক নিয়ন্ত্রণে রাখতে নিজের কাছে রাখতে পারেন ব্লটিং পেপার। এছাড়াও নরম ফ্লানেল কাপড়ও, যা সাধারণত চশমার বাক্সগুলোতে দেওয়া থাকে, এই ক্ষেত্রে বেশ উপকারী।
তৈলাক্ত ত্বকের জন্য কিছু ইফেক্টিভ ফেসপ্যাক
নিচে কিছু প্রচলিত প্রাকৃতিক ফেসপ্যাক সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।
লেবুর ফেসপ্যাক
তৈলাক্ত ত্বকের জন্য সবচেয়ে কার্যকরী ঘরোয়া উপাদান হলো লেবু। কারণ এতে থাকে সাইট্রিক এসিড যা ত্বকের তৈলাক্ততাকে নিয়ন্ত্রণ করার পাশাপাশি ব্যাকটেরিয়াকেও প্রতিরোধ করে। ফলে ব্রণের সমস্যা কমে যায়। লেবুর রসের সাথে ১:১ অনুপাতে মধু মিশিয়ে এই মিশ্রণ ত্বকে লাগান। ১০ থেকে ১৫ মিনিট পর ঠাণ্ডা পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলুন। মধুর পরিবর্তে আপেলের রসও ব্যবহার করা যায়। সপ্তাহে দুইদিন এই ফেসপ্যাক ব্যবহার করতে পারেন। এছাড়াও লেবুর রস ও গোলাপজলের মিশ্রণ মুখে লাগিয়ে আধা ঘণ্টা পর তুলাজাতীয় কিছু দিয়ে আলতোভাবে মুখ পরিস্কার করলে এটি তেলতেলে ভাব দূর করার পাশাপাশি ব্রণ বা ফুসকুড়ির দাগও দূর করতে সাহায্য করবে।
কমলালেবু খোসার ফেসপ্যাক
ত্বকের তৈলাক্তভাব দূর করতে কমলালেবুর খোসা একটি পরিচিত উপাদান। এর জন্য এটিকে শুকিয়ে গুড়া করে নিতে হবে। তারপর এটি দুই চা চামচ নিয়ে এর সাথে চার চা চামচ দুধ ও এক চামচ কাঁচা হলুদবাটা মিশিয়ে একটি পেস্ট তৈরি করুন। এটি মুখে লাগিয়ে ১৫ থেকে ২০ মিনিট পর ধুয়ে ফেলুন। এটি আপনার ত্বকের তৈলাক্ততাকে দূর করার পাশাপাশি আপনার ত্বককে করে তুলবে আরো উজ্জ্বল।
বেসনের ফেসপ্যাক
বেসনকে বলা হয় প্রাকৃতিক ফেস ওয়াশ। কারণ এটি অতিরিক্ত তেল শুষে নিতে পারে। বেসন ও দুধ ১:২ অনুপাতে মিশিয়ে একটি পেস্ট বানান। তারপর এটি মুখে লাগিয়ে ভালোমতো শুকিয়ে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করুন। এরপর ধুয়ে ফেললে আপনি নিজেই বুঝতে পারবেন একে কেন প্রাকৃতিক ফেসওয়াশ বলা হলো। সপ্তাহে দুইদিন এই ফেসপ্যাক ব্যবহার করতে পারেন।

ডিমের ফেসপ্যাক
ডিমের সাদা অংশ ত্বকের জন্য বেশ উপকারী। এটি ত্বকের অতিরিক্ত তেল দূর করার পাশাপাশি ত্বককে টানটান রাখতেও সাহায্য করে। ডিমের সাদা অংশের সাথে শশার নির্যাস এবং পুদিনা পাতার পেস্ট মিশিয়ে একটি মিশ্রণ তৈরি করুন। এটি মুখে লাগিয়ে শুকিয়ে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করুন। এরপর ধুয়ে ফেলুন। পুদিনার Antibacterial উপদান আপনার ত্বককে ব্রণ থেকে রক্ষা করবে এবং শশার নির্যাস একে ভেতর থেকে ঠাণ্ডা রাখবে।
পাকা কলার ফেসপ্যাক
তৈলাক্ত ত্বকের জন্য পাকা কলার ফেসপ্যাকও বেশ কার্যকরী একটি সমাধান। এটি তৈরি করতে একটি পাকা কলা নিন। এর সাথে এক চা চামচ পরিমাণ মধু এবং দুই চা চামচ লেবুর রস মিশিয়ে নিতে পারেন। তারপর সবগুলো মিলিয়ে একটি ঘন পেস্ট তৈরি করুন। এটি ত্বকে লাগিয়ে ১৫ মিনিট অপেক্ষা করুন এবং এরপর কুসুম গরম পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলুন। সপ্তাহে দুই দিন বা তিনদিন এই ফেসপ্যাক ব্যবহার করতে পারেন।
শসার ফেসপ্যাক
শসার ফেসপ্যাক ব্যবহারেও তৈলাক্ত ত্বকে ভালো ফল পাওয়া যায়। পাশাপাশি এটি আপনার ত্বককে রাখবে ভিতর থেকে ফ্রেশ। দুই চা চামচ শসার পেস্টের সাথে এক চামচ গোলাপজল মিশিয়ে নিন। অল্প কয়েক ফোঁটা লেবুর রসও দিতে পারেন। এরপর এই মিশ্রণ মুখে লাগিয়ে ১৫ থেকে ২০ মিনিট রেখে ঠান্ডা পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলুন। ভালো ফলাফলের জন্য এটি আপনি রোজও করতে পারেন।
অ্যালোভেরার ফেসপ্যাক
ত্বকের অতিরিক্ত তেল নিয়ন্ত্রলে অ্যালোভেরা জেলের ব্যবহারও বেশ কার্যকরী। অ্যালোভেরা জেলের সঙ্গে ১:১ অনুপাতে মধু মিশিয়ে পানার ত্বকে প্রয়োগ করুন। ভালো ফলাফলের জন্য একটু সময় নিয়ে অপেক্ষা করুন এবং এরপর ধুয়ে ফেলুন। মধু ছাড়াও আপনি অ্যালোভেরা জেলের সঙ্গে আপনার সুবিধামতো গোলাপজল বা শশার নির্যাস বা বেসন মিশিয়েও ফেসপ্যাক তৈরি করতে পারেন। এগুলোও বেশ ভালো কাজ করে।
হলুদের ফেসপ্যাক
হলুদও তৈলাক্ত ত্বকের জন্য বেষ উপকারী। পাশাপাশি এর রয়েছে অ্যান্টিসেপটিক এবং অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল বৈশিষ্ট্য। একটি পাত্রে এক চা চামচ হলুদ গুড়া নিন। এরপর পরিমাণমতো লেবুর রস মিশিয়ে একটি পেস্ট তৈরি করুন এবং আপনার ত্বকে প্রয়োগ করুন। ৫ থেকে ১০ মিনিট অপেক্ষা করুন; এরপর কুসুম গরম পানি দিয়ে মুখ ধুয়ে নিন। লেবুর রস এর পরিবর্তে আপনি নারিকেল তেলও ব্যবহার করতে পারেন।
আজকের জন্য এতটুকুই থাক। তবে শেষ করার আগে আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ কথা বলি। ত্বকের যত্নে বাহ্যিক প্রসাধনীর পাশাপাশি ভেতর থেকে পুষ্টি নিশ্চিত করাও জরুরী। এজন্য খাদ্যতালিকায় সবুজ শাকসবজি এবং রঙিন ফলমূল রাখুন। ত্বককে আর্দ্র রাখতে পর্যাপ্ত পানি পান করুন। শেষ পর্যন্ত পড়ার জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ। এরকম আরো লেখা পেতে আমাদের সাথেই থাকুন। আর আপনাদের কোনো মতামত বা জিজ্ঞাসা থাকলে আমাদের তা কমেন্টে জানাতে ভুলবেন না কিন্তু!