বর্তমান সময়ে সৌন্দর্য রক্ষায় অলিভ অয়েল হতে পারে আপনার বিশ্বস্ত বন্ধু। ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে স্বাস্থ্যসম্মত খাদ্য হিসাবে এর অনেক কদর আছে। স্বাস্থ্য পরিচর্যা, ঘর-গৃহস্থালির জিনিসপত্র পরিষ্কার করার কাজেও ব্যবহৃত হয়ে থাকে অলিভ অয়েল।
অনেক গুণের অধিকারী এই অলিভ অয়েল সৌন্দর্যচর্চার ক্ষেত্রেও বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে। এটি চুলের যত্ন নিতেও পারদর্শী। আসুন জেনে নেই অলিভ অয়েলের বিভিন্ন উপকারিতা এবং চুলের যত্নে এর নানাবিধ ব্যবহারবিধি –
অলিভ অয়েলের প্রকারভেদ
অলিভ অয়েল বের করা হয় মূলত জলপাইয়ের ফল থেকে অর্থাৎ জলপাই তেলকে অলিভ অয়েল বলা হয়। এর পরে এটি ভিন্ন ভিন্ন পরিশোধন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে তৈরি করা হয়। এই অলিভ অয়েলে আবার বিভিন্ন প্রকারের হয়ে থাকে। এর প্রকারভেদ নিচে দেওয়া হল –
ভার্জিন অলিভ অয়েল
সাধারণত প্রতি কেজি ভার্জিন অলিভ অয়েলে ১৫০ থেকে ৪০০ মিলিগ্রাম পর্যন্ত পলিফেনল উপাদান বিদ্যমান থাকে। এই পলিফেনল হল উদ্ভিদের খাবারে পাওয়া ফাইটোকেমিক্যাল। যা এই ভার্জিন অলিভ অয়েলে রয়েছে।
এছাড়াও ভার্জিন অলিভ অয়েলের অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট বৈশিষ্ট্য রয়েছে। ভার্জিন অলিভ অয়েল হল অলিভ অয়েলের সবচেয়ে বিশুদ্ধতম রূপ বা প্রিমিয়াম গ্রেড। এর স্বাদ ও গন্ধ অন্যান্য অলিভ অয়েলের তুলনায় অনেক ভালো ।
রিফাইন্ড অলিভ অয়েল
রিফাইন্ড অলিভ অয়েল হলো সবচেয়ে নিম্নমানের অলিভ অয়েল। প্রতি কেজি পরিশোধিত বা রিফাইন্ড অলিভ অয়েলে মাত্র ০ থেকে ৫ মিলিগ্রাম পরিমাণে পলিফেনল পাওয়া যায়।
অলিভ অয়েল
এই ধরনের অলিভ অয়েলকে খাঁটি অলিভ অয়েল বলে মনে করা হয়। এটি রিফাইন্ড এবং ভার্জিন অলিভ অয়েল একসাথে মিশিয়ে তৈরি করা হয়, যার কারণে এতে পুষ্টি মিডিয়াম পরিমাণে থাকে। প্রতি কেজি খাঁটি অলিভ অয়েলে ১০ থেকে ১০০ মিলিগ্রাম পর্যন্ত পলিফেনল পাওয়া যায়।
পোমেস অলিভ অয়েল
এটি অলিভ অয়েল এবং ভার্জিন অলিভ অয়েলের প্রথম পাল্প থেকে তৈরি করা হয়। প্রতি কেজি পোমেস অলিভ অয়েলে ১০ থেকে ৩০ মিলিগ্রাম পর্যন্ত পলিফেনল পাওয়া যায়।
চুলের জন্য আপনি খাঁটি অলিভ অয়েল বা ভার্জিন অলিভ অয়েল ব্যবহার করতে পারেন, কারণ এই দুই ধরনের অলিভ অয়েলের গুণমান এবং পুষ্টিগুণ বেশী ।
চুলের জন্য অলিভ অয়েল কতটা উপকারী ?
আপনার সৌন্দর্য রক্ষায় অলিভ অয়েল শুধু যে ত্বকের যত্ন নেয় তা কিন্তু নয়।অলিভ অয়েল চুলের যত্ন নিতেও এক অনবদ্য ভূমিকা পালন করে।এছাড়াও চুল এর নানাবিধ উপকার সাধন করে। আসুন জেনে নেই চুলের যত্নে অলিভ অয়েল যেসব উপকার করে-

- এই তেল চুল পড়া কমাতে সাহায্য করে।
- ডগাছেরা চুল সারিয়ে তুলতে পারে।
- চুলের বৃদ্ধিতে সাহায্য করে।
- চুলের রুক্ষতা দূর করে।
- নরম, কোমল এবং স্বাস্থ্যোজ্জ্বল চুল পাবেন এই তেলের গুণেই।
- খুশকি দূর করে চুলকে স্বাস্থ্যোজ্জ্বল করে তুলে।
- অলিভ অয়েল সব ধরনের চুলেই ব্যবহারকরা সম্ভব হয়।
- এই তেল হালকা এবং এর মধ্যে একাধিক হিলিং উপাদান আছে।
- সোজা চুল কিংবা কোঁকড়া চুলে এই তেল ব্যবহার করা যায়।
- চর্মরোগের জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে।
চুলে কেন অলিভ অয়েল ব্যবহার করবেন
অলিভ অয়েলে চুলের জন্য অনেক উপকারী উপাদান আছে। এটিতে রয়েছে ওমেগা-৩ অ্যাসিড ও অন্যান্য নিউট্রিয়েন্টস। যা চুলের গ্রোথ বাড়ায়। আর চুল পড়া কমাতে সাহায্য করে। আপনার স্ক্যাল্পে যদি চুলকানি থেকে থাকে এবং ড্যানড্রাফের সমস্যা থাকে। তাহলে অলিভ অয়েল ব্যবহার করতে পারেন। এতে এই সমস্যা অনেকাংশে কমে যাবে।
এছাড়াও অলিভ অয়েল ড্রাই স্ক্যাল্পের প্রবলেম সলভ করে হেয়ার কিউটিকেলকে সফট করে। চুল জটমুক্ত করে এবং চুলকে নিমিষেই ঝরঝরে করতে সাহায্য করে। এমন নানাবিধ গুণের জন্য আপনিও অলিভ অয়েল ব্যবহার করতে উৎসাহিত হবেন।
চুলে অলিভ অয়েল ব্যবহারের নিয়ম
চুলের যত্নে অলিভ অয়েল খুবই কার্যকরী একটি উপাদান। এটি আপনার চুলের প্রাকৃতিক জেল্লা ধরে রাখতে সাহায্য করে থাকে। পাশাপাশি চুলে পুষ্টির জোগান দেয়। এর মধ্যে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন ই, পলিফেনল থাকে। তাই অলিভ অয়েলের হেয়ার মাস্ক বানিয়ে আপনি সহজেই চুলে ব্যবহার করতে পারেন। আসুন জেনে নেই সহজ ৩ টি নিয়ম –
অলিভ অয়েল ও ডিমের হেয়ার মাস্ক
ডিমে আছে উপকারী ভিটামিন-বি। যা আপনার চুলের জন্য প্রয়োজন রয়েছে। আপনি ডিম, অলিভ অয়েল মিশিয়ে হেয়ার মাস্ক বানিয়ে নিন নিম্নোক্ত উপায়ে –
একটি পাত্রে একটি ডিম ফাটিয়ে নিন। তার সঙ্গে দুই টেবিল চামচ অলিভ অয়েল নিয়ে মেশান। এই দুই উপকরণ ভালো করে মিশিয়ে একটি ঘন মিশ্রণ তৈরি করুন। এই হেয়ার মাস্ক আপনার চুলে লাগিয়ে এক থেকে দেড় ঘণ্টা পর শ্যাম্পু করে ফেলুন। সপ্তাহে দুই থেকে তিন দিন এই হেয়ারমাস্ক ব্যবহার করতে পারেন।
অলিভ অয়েল এবং কলার হেয়ার মাস্ক
একটি পাত্রে একটা কলা ভালোভাবে চটকে নিন। তার মধ্যে এক টেবিল চামচ অলিভ অয়েল মিশিয়ে দিন। এই দুই উপকরণ মিশিয়ে ঘন মিশ্রণ তৈরি করুন। আপনার হেয়ার মাস্ক তৈরি হয়ে গেলো। এবার এটা আপনার চুলে লাগিয়ে নিন। তারপর ৩০ মিনিট অপেক্ষা করে শ্যাম্পু করে ফেলুন। সপ্তাহে অন্তত ১-২ বার এই হেয়ার মাস্ক ব্যবহার করুন। দেখবেন আপনার চুল কতটা উজ্জ্বলতা দিচ্ছে।
অলিভ অয়েল হালকা গরম করে
যাদের চুল রুক্ষ এবং শুষ্ক তারা অলিভ অয়েল হালকা গরম করে স্ক্যাল্পে ভাল করে মালিশ করুন এতে রক্ত সঞ্চালন বৃদ্ধি পায়। চুলকে ময়েশ্চারাইজ করে এবং চুলকে উজ্জ্বল রাখতে সাহায্য করে।
কীভাবে আপনার চুলে অলিভ অয়েল ব্যবহার করবেন
আপনার চুল চকচকে এবং স্বাস্থ্যকর হয়ে উঠতে সাহায্য করার জন্য এটির সর্বাধিক ব্যবহার করতে একটি প্রি-কন্ডিশনার হিসাবে অলিভ অয়েল ব্যবহার করুন।

- একটি তোয়ালে দিয়ে আপনার চুলের উপরের অংশটি ঢেকে রাখুন, যাতে আপনি এটিতে তৈলাক্ত ফোঁটা না পান (যদি আপনি তা করেন তবে আপনি আপনার টপটি ধোয়ার আগে কিছু সাবান দিয়ে ঘষুন)।
- এবার আপনার এক্সট্রা ভার্জিন অলিভ অয়েল নিন।
- একটি ছোট বাটিতে 2 টেবিল চামচ এবং ১/৪ কাপ বা আপনার চুলের দৈর্ঘ্য এবং বেধের উপর নির্ভর করে। আপনার চুল লম্বা বা ঘন হলে আরও বেশি করে ঢেলে দিন।
- চুলের শেষ অংশ থেকে শুরু করে, আপনার চুলে এক্সট্রা ভার্জিন অলিভ অয়েল ম্যাসাজ করুন। এবার আপনার মাথার ত্বকে কিছু তেল ম্যাসাজ করুন।
- চওড়া দাঁতের চিরুনি দিয়ে চুল আঁচড়ান এবং তারপর ঝরনার দিকে যান।
- শাওয়ারে আপনার চুল ভিজিয়ে নিন এবং তারপর ভালোভাবে শ্যাম্পু করুন (আপনার দুই রাউন্ড শ্যাম্পুর প্রয়োজন হতে পারে) সমস্ত তেল বের করার জন্য।
- স্বাস্থ্যকর, চকচকে চুলের জন্য সপ্তাহে একবার এটি পুনরাবৃত্তি করুন
অলিভ অয়েল কি চুলের বৃদ্ধির জন্য ভালো?
যদিও অলিভ অয়েলকে চুলের বৃদ্ধির সাথে সরাসরি যুক্ত করার বৈজ্ঞানিক প্রচুর প্রমাণ নাই, তবে অলিভ অয়েলর বৈশিষ্ট্যগুলি লক্ষ্য করা উচিত যা এটিকে স্বাস্থ্যকর চুলের প্রচারের জন্য সম্ভাব্য করে তুলতে পারে।
অলিভ অয়েল মনোস্যাচুরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিড, ভিটামিন ই এবং কে, পাশাপাশি অ্যান্টিঅক্সিডেন্টগুলিতে সমৃদ্ধ। এই সমস্ত পুষ্টিগুলি চুলের স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। যা হার্ট-স্বাস্থ্যকর চর্বি হিসাবে বিবেচিত হয়। এই চর্বিগুলি সামগ্রিক স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এবং চুলের ফলিকলগুলির জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টি সরবরাহ করে স্বাস্থ্যকর চুলের বৃদ্ধিতেও ভূমিকা রাখতে পারে।
সম্প্রতি কয়েকটি গবেষণার মধ্যে একটি যা এই ধারণাটিকে সমর্থন করেছিল যে অলিভ অয়েল চুলের বৃদ্ধির জন্য ভাল। অতি সম্প্রতি, মিয়ামি ইউনিভার্সিটির কার্ডিওভাসকুলার হেলথ নিয়ে গবেষণায় দেখা গেছে যে অলিভ অয়েল, বিশেষ করে ভার্জিন টাইপ অলিভ অয়েল, রক্ত প্রবাহকে উৎসাহিত করে এবং এর সমৃদ্ধ অ্যান্টিঅক্সিডেন্টের কারণে প্রদাহ কমায়।
সেইসাথে ভিটামিন কে যার সবগুলোই এর মূল কারণ। চুলের স্বাস্থ্য এবং বিশেষ করে বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। তাই বলা যাচ্ছে যে অলিভ অয়েল চুলের বৃদ্ধির জন্য ভালো হিসেবে বিবেচনা করা যায়।
সর্বোপরি এই তেল আপনার চুলের পুষ্টি, আর্দ্রতা সংরক্ষণ, DHT স্তর হ্রাস, ক্ষতি প্রতিরোধ, এবং ভাঙন হ্রাস সহ একাধিক সুবিধা প্রদান করে যা এটি আপনার চুলের যত্নের রুটিনে একটি উপযুক্ত সংযোজন করে তোলে। আশা করি বুঝতে পারছেন।