কোনো একটি অনুষ্ঠানে যাওয়ার আগেই কেন আপনি সাজতে বসে যান কিংবা বাইরে বের হওয়ার আগেই কেন ক্রিম দেয়ার কথা মনে হয় বলুন তো? উত্তর হয়তো আপনি দিতে চাইবেন না। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এটি মূলত অন্যকে দেখানোর জন্য কিংবা নিজের আউটলুক ঠিক রাখার জন্য। নিজের ইমেজ নিয়ে ভাবতে ভাবতে আমরা আজ এতটাই কৃত্রিম হয়ে গেছি যে তা বলে বুঝানোর মতো না। কিন্তু কেন এমন বলছি?
কারণ আছে অবশ্যই। তবে তার আগে আরেকটি বিষয় আপনি যে এই কৃত্রিমভাবে অপরের সামনে নিজেকে উপস্থাপন করছেন তাতে লাভটা কতটুকু? খুবই নগণ্য কিংবা নেই। তবে এর ফলে আমরা যা করতে ভুলে যাই তার প্রভাব অনেক বড়। সে যাই হোক, এত এত ব্যস্ততার ভিড়ে এসব নিয়ে ভাবতে বসার সময়ই হয়তো আপনার নেই।
তবে একটু মনযোগ চেয়ে নিচ্ছি। কেননা নিজের এই ঠাটবাট বজায় রেখে চলা স্বভাবের ফলে আপনার প্রকৃতই আমরা যে জিনিসগুলো ভুলে যাই ত্বকের যত্ন নেয়ার ক্ষেত্রে তার মধ্যে রয়েছে নাইট কেয়ার। আজ তাই আমরা খুব ক্ষুদ্র পরিসরে জানার চেষ্টা করব রাতে ত্বকের যত্ন নেয়ার গুরুত্ব নিয়ে। একই সাথে আপনার জন্য নাইট ক্রিম কোনটি ভালো কিংবা তৈলাক্ত ত্বকের জন্য কোন নাইট ক্রিম ভালো? তার জবাব দেয়ার চেষ্টা করব। আর আমাদের পুরো পোস্টটি বিভিন্ন জার্নালের তথ্য নিয়ে বানানো।
শেষ পর্যন্ত আমাদের সাথেই থাকুন।
নাইট ক্রিম কি?
প্রথমত আমাদের একটি ভুল ধারণা ভেঙ্গে দেয়া যাক। নাইট ক্রিমকে আমরা অনেকেই সাধারণ ক্রিমের মতোই মনে করে থাকি। তবে তা কিন্তু মোটেও নয়। নাইট ক্রিম মূলত রাতে দেয়ার জন্যই বিশেষভাবে বানানো এক ধরনের ক্রিম। যেখানে বিভিন্ন উপাদানের সংমিশ্রণ থেকে থাকে। আর রাতে ও দিনের এই আলাদা বিষয়টিকে সামনে রেখেই ডা পিলিয়াং একটি মতামত দেন এই ক্রিমগুলোর বৈশিষ্ট্য সমন্ধে। যেমনঃ নাইট ক্রিমের ক্ষেত্রে যদি দেখতে যাই, তাকে মূলত এমন ভাবে বানানো হয় যাতে রাতে আমাদের কোষের যে রিজেনারেশন হয় তা আরও বেশি তরান্বিত হয়। জ্বী হ্যাঁ নাইট ক্রিম ঠিক কাজে সহায়তা করে থাকে। আর এর জন্য তাকে ত্বকের গভীরে যেতে হয়।

কিন্তু দিনের ক্রিমের কি একই উদ্দেশ্য?
মোটেও না। বরং দিনে মূলত আমরা ক্রিম ব্যবহার করে থাকি ত্বকের প্রতিরক্ষার জন্য। যেমন ধরে সানস্ক্রিন ক্রিমের কথাই ভাবুন। ঠিক একইভাবে বাকিগুলোর উদ্দেশ্যও মোটামুটি একই ধাচের। আশা করি এই ভুল ধারণা আপনাদের ঘুচেছে।
নাইট ক্রিমের উপাদান
নাইট ক্রিম সমন্ধে বিস্তারিত জানার এ পর্যায়ে এর উপাদানগুলো জেনে নেয়া আবশ্যক মনে করছি। কেননা এতে করে এর উপকারিতা সমন্ধেও একটা ধারণা পাওয়া যাবে যদিও তা আমরা পরবর্তীতে আলোচনা করতেই যাচ্ছি।
- রেটিনলঃ ভিটামিন এ এর এই ডেরিভেটিভটি পাওয়া যায় নাইট ক্রিমে। এর মধ্যে রয়েছে এন্টি-এজিং বৈশিষ্ট্য। সেই সাথে এটি সূক্ষ্ম লাইন কিংবা কুচকানি ও ব্রাউন স্পট সরিয়ে ফেলতে সহায়তা করে থাকে। পাশাপাশি আপনার ত্বক উজ্জ্বল করতেও রয়েছে এর বিশেষ ভূমিকা। তবে সাবধান বেশি ক্রিম ব্যবহারে আপনার ত্বকের ক্ষতিও হতে পারে।
- হায়ালিউরোনিক এসিডঃ এটি এমন একটি উপাদান যা আপনার শরীর অটোমেটিকভাবেই উৎপন্ন করে থাকে যেমন আপনার লাইসোজোম থেকেই এমন উপাদান উৎপন্ন হয়। যাই হোক, মুখের যে হায়ালিউরোনিক এসিড ব্যবহার করা হয় তা মূলত উদ্ভিদ থেকে সংগ্রহ করা হয় ও ল্যাবে উৎপন্ন।
- ভিটামিন ইঃ এটি মূলত চর্বিতে দ্রবণীয় একটি ভিটামিন যা স্কিনের জন্য বেশ ভালো। আপনি কি জানেন আপনার বয়স বৃদ্ধিতে এটি কমে যায় আর তার কারণেই মূলত বুড়িয়ে যাওয়ার মতো ব্যাপারগুলো হয়। যাই হোক, এছাড়াও অত্যধিক রোদে থাকার কারণেও এমনটা হতে পারে। আর নাইট ক্রিমের ব্যবহারে তা বেড়ে যাবে যেহেতু উপাদানে তা পাচ্ছেন।
- আলফা হাইড্রক্সি এসিড ও বিটা হাইড্রক্সি এসিডঃ কি চিনতে পারছেন না? এই ফেসিয়াল এসিডগুলো মূলত কয়েকটি বা কতগুলো এসিডের সামগ্রিক নাম। এদের মধ্যে রয়েছে সাইট্রিক এসিড এবং বাদবাকি ফলীয় এসিড সমূহ। যা আপনার ত্বকের জন্য বেশ ভালো।
- রেসভ্রাট্রলঃ এটি মূলত একটি এন্টি-অক্সিডেন্ট যা মূলত নাইট ক্রিমে পাওয়া যায়। আর এর অন্যতম একটি কাজ হলো স্ট্রেস বা চাপ কমিয়ে দেয়া। দৈন্দদিন ব্যবহারে এর উপকারিতা পাবেন আপনিও।
মোটা দাগে এ কয়েকটি উপাদান উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও আপনি যদি গুগলে সার্চ করেন সেক্ষেত্রে দেখতে পাবেন ১৫-২০টি উপাদান রয়েছে এখানে।
নাইট ক্রিমের উপকারিতা
যেমনটা শুরুতেই বলেছি আমাদের ত্বক মূলত রাতের বেলায় নিজেকে হিল করে বা সারিয়ে নেয়। নিজের ক্ষতগুলো সারিয়ে নেয়াই রাতের মুখ্য উদ্দেশ্য। নিভিয়া ডট কমের একটি তথ্যমতে এই সারিয়ে নেয়ার কাজটি রাত ৯টা থেকে মধ্য রাত পর্যন্ত চলতে থাকে। আবার অন্য একটি পোর্টাল অনুযায়ী তা রাত ১০টা থেকে ২টা পর্যন্ত হয়ে থাকে।
মোট কথা মাঝামাঝি এই সময়টাতেই হয়ে থাকে। আর এই কাজকে বাড়িয়ে দিতেই নাইট ক্রিম কাজ করে থাকে। যা সার্বজনীন উপকারিতাগুলোর একটি। এর বাইরেও দেখা যায় আমাদের ছাইরঙা চেহারার উন্নতি ঘটানোতে এর ভূমিকা রয়েছে। এছাড়াও আমাদের ত্বককে আরও নরম করে তোলার পিছনে কাজ করে এতে থাকা আলফা ও বিটা হাইড্রক্সি এসিড।

পাশাপাশি হায়ালিউরোনিক এসিড মূলত ময়েশ্চারকে শুষে নেয় এবং আপনার ত্বককে আরও মাংসল বানায়। পাশাপাশি সূক্ষ্ম দাগ, কুচকানি কিংবা স্কিন পিগমেন্ট ইস্যুতে সহায়তা করে। আর ভিটামিন ই সম্পর্কে যে বিষয়টি তা হলো এইটি ময়েশ্চারাইজেশনে সহায়তা করে এবং আপনার রং উজ্জ্বল করতে সহায়তা করে। এটা মূলত আমাদের সিবামেরও একটি উপাদান। যা মূলত আমাদের ত্বকের তৈরি করা তেল নিজের প্রতিরক্ষার কাজেই ত্বক একে ব্যবহার করে থাকে।
অনেকেরই সমস্যা থাকে লালচে ভাব কিংবা জ্বালাপোড়া। অনেকেই তো আবার হাইপারপিগমেন্টেশনে ভুগে। এই সবগুলোর জন্য নাইট ক্রিমেরে রেসভ্রাট্রল উপাদানটি বেশ কার্যকর। যা এজিং থেকে দূরে রাখে।
নাইট ক্রিমের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া
এ পর্যায়ে অনেকের প্রশ্ন থাকতে পারে নাইট ক্রিম ভালো কি না? বা এর কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে কি না। ওয়েবএমডির মতে এক্ষেত্রে বেশিরভাগ ক্রিমের তেমন কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকে না। তবে পুড়ে যাওয়া, লালচে ভাব কিংবা জ্বালাপোড়া দেখা যেতে পারে। যার জন্য অবশ্যই আপনাকে উপরোক্ত ধাপ মেনে আগে সঠিক ক্রিম নিজের জন্য বাছাই করে নিতে হবে। আর অবশ্যই নিজের ব্যক্তিগত ডার্মাটোলজিস্টের সাথে পরামর্শ করা অতীব জরুরি।
ডা পিলিয়াং এক্ষেত্রে বলেন আপনাকে ধীরে ধীরে শুরু করতে হবে। যেমন ধরুন সপ্তাহে ৩বার। আর কতটুকু সহ্য করতে পারছে তার উপর ভিত্তি করে বাড়ানো। আর অবশ্যই যদি আপনার ত্বক অত্যধিক সংবেদনশীল হয়ে থাকে সেক্ষেত্রে প্রচুর সচেতন হতে হবে।
আপনার জন্য নাইট ক্রিম কোনটি ভাল?
আপনার জন্য কোন নাইট ক্রিমটি ভালো এইটি নির্ণয়ের ক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয়কে প্রাধান্য দিতে হবে। সকলের জন্যই কখনো এই প্রক্রিয়াটা একই হতে পারে না। কেননা একেকজনের ত্বক একেকরকম হয়ে থাকে। যেমন আফ্রিকানদের ত্বক একটু বেশি প্রতিরক্ষাশীল তবে অনেক কোমল হলেও পশ্চিমাদেরটা সেন্সিটিভ। দেখে নেয়া যাক সেসব বিষয়ঃ

- শুষ্ক ত্বক : অনেকেরই এমন রয়েছে যাদের ত্বক বেশ শুষ্ক। এক্ষেত্রে আপনাকে নিজের ক্রিম বাছাইয়ের কয়েকটি উপাদান দেখে নিতে হবে। যেমন হায়ালিউরোনিক এসিড, গ্লিসারিন, এবং সিরামাইডস। এগুলো গভীরভাবে ত্বককে হাইড্রেট করে এবং ত্বককে নারিশ করে। চ্যাটজিপিটির সাজেশনানুসারে CeraVe, La Roche-Posay, এবং Kiehl’s কোম্পানির ক্রিম দেখা যেতে পারে। তারা ড্রাই স্কিনের জন্য ভালো ক্রিম সরবরাহ করে থাকে।
- তৈলাক্ত ত্বক: অনেকেরই ত্বক রয়েছে যা প্রায় বেশিরভাগ সময়ই তৈলাক্ত থাকে। আর এক্ষেত্রে যা সাজেস্টেড তা হলো তৈলবিহীন কিংবা নন-কোমেডোজেনিক ফর্মুলা অনুসারে বানানো নাইট ক্রিম। যা মূলত আপনার ত্বকের পোর বা ছিদ্রগুলোকে জমাটবদ্ধ করবে না। এক্ষেত্রে যে যে উপাদান আপনার দেখা উচিত তা হলো salicylic acid, niacinamide এবং retinol। এগুলো মূলত তেল উৎপন্ন ও ব্রেকআউট প্রতিরোধে ভূমিকা রাখে। তৈলাক্ত ত্বকের জন্য কিংবা একনে প্রোন ত্বকের জন্য Neutrogena, Paula’s Choice, এবং Differinন কোম্পানি বেশ ভালো হতে পারে। তবে অবশ্যই দেখে নিবেন।
- সংবেদনশীল ত্বকঃ আপনার ত্বক কি একটু বেশিই সংবেদনশীল সেক্ষেত্রে আপনাকে অবশ্যই একটু সচেতন হতে হবে। আর আপনার আপনার দরকার একটু অত্যধিক সুগন্ধ বিহীন ফর্মুলা। আপনার জন্য এক্ষেত্রে ক্রিমে যে উপাদান দরকার তা হলো chamomile, aloe vera, এবং colloidal oatmeal। সংবেদনশীল ত্বকের জন্য Cetaphil, Aveeno এবং Eucerin এর মতো কোম্পানিগুলো ক্রিম বানিয়ে থাকে।
- Anti-Aging: আপনি কি সূক্ষ্ম রেখা কিংবা কুঁচকে যাওয়া নিয়ে চিন্তিত? বা আন-ইভেন স্কিন টোন নিয়ে চিন্তিত? সেক্ষেত্রে আপনার নাইট ক্রিমে যেসব বিষয়াদি দেখা উচিত তা হলোঃ retinol, peptides, vitamin C এবং antioxidants। এক্ষেত্রে কোন ব্রান্ড ব্যবহার করবেন? এক্ষেত্রে দেখা যেতে পারেOlay Regenerist, RoC, এবং Drunk Elephant এর মতো কোম্পানিগুলো।
- প্রাকৃতিক কিংবা অর্গানিক ক্রিমঃ অনেকেরই আবার পছন্দ প্রাকৃতিক কিংবা অর্গানিক কিছু। সেক্ষেত্রে উদ্ভিজ্জ সামগ্রী সম্বলিত ক্রিম দেখা যেতে পারে। সেক্ষেত্রে যে যে উপাদান থাকতে হবে তা হলোঃ shea butter, jojoba oil এবং botanical এক্ষেত্রে ব্রান্ড যেমন Burt’s Bees, Avalon Organics এবং Originsন এর মতো কোম্পানি রয়েছে।
আর অবশ্যই আপনার মনে রাখতে হবে স্কিনের জন্য সবার ক্ষেত্রেই একেক রকম ক্রিম লেগে থাকে। তাই আপনার স্কিনের জন্য কোন ক্রিমটি ভালো তার জন্য নিজের ত্বক সমন্ধে আগে জানুন। তাহলে সিদ্ধান্ত নেয়া সুবিধা হবে।
উপসংহার
নাইট ক্রিম ত্বকের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তবে মনে রাখতে হবে আপনার ত্বক বিশেষ করে মুখমণ্ডল খুবই সংবেদনশীল হয়ে থাকে। তাই একটু এদিক ওদিকে হয়ে গেলেই এলার্জিক রিয়াকশন কিংবা অন্য কিছু ঘটে যেতে পারে। যা আপনার ত্বককে নষ্ট করে দেয়ার জন্য যথেষ্ট। তাই অবশ্যই নিজের ডার্মাটোলজিস্টের সাথে পরামর্শ করে জানুন বিষয়টি। তারপর নিজের নাইটক্রিম সংগ্রহ করুন। এর পরবর্তীতে কি নিয়ে জানতে চান, তা জানান কমেন্টে।