সূর্যের UV রশ্মির কারণে ত্বকের পুড়ে যাওয়া কে সানবার্ন বলে। যখন আমাদের ত্বক অতিরিক্ত UV রশ্মির সংস্পর্শে আসে। তখন তা ত্বকে লালভাব, ব্যথা, ফোলাভাব এবং চুলকানির সৃষ্টি করে। সানবার্ন মূলত ত্বকের উপরের স্তরে প্রভাব ফেলে। যা আমাদের শরীরের জন্য অস্বস্তিকর এবং কখনো কখনো গুরুতরও হয়ে থাকে। যাদের ত্বক পাতলা এবং দীর্ঘ সময় সূর্যের সংস্পর্শে থাকে, তাদের সানবার্ন হওয়ার ঝুঁকি বেশি।
সানবার্নের প্রতিকার হিসেবে ঠাণ্ডা পানিতে গোসল, অ্যালোভেরা জেল বা দুধের প্যাক ব্যবহার করা যেতে পারে। ত্বককে ময়শ্চারাইজ রাখতে প্রচুর পানি পান করা কার্যকর। প্রতিরোধের জন্য সানস্ক্রীন ব্যবহার এবং সূর্যের আলো থেকে সুরক্ষিত থাকা জরুরি। সঠিক যত্ন নিলে সানবার্নের প্রভাব কমানো সম্ভব। আজ আমরা জানবো সানবার্নের কারণ, লক্ষণ এবং সানবার্ন দূর করার উপায় সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করব।
সানবার্ন দূর করার উপায়
নিচে সানবার্ন দূর করার উপায় সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হল।
সানবার্নের কারণ

সানবার্ন হল একটি প্রচলিত সমস্যা, যা সূর্যের UV (আলট্রা ভায়োলেট) রশ্মির কারণে ঘটে। UV রশ্মি মূলত দুই ধরনের: UVA এবং UVB। UVA রশ্মি ত্বকের গভীরে প্রবেশ করে, যা দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি করে। যেমন বলিরেখা এবং ত্বকের ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়। অন্যদিকে, UVB রশ্মি সরাসরি ত্বকের উপরের স্তরে কাজ করে এবং ত্বক পুড়ে যাওয়ার জন্য মূলত দায়ী।
সানবার্নের ঝুঁকি বাড়ানোর কিছু বিশেষ কারণ রয়েছে:
- অতিরিক্ত সূর্য প্রদর্শন: দীর্ঘ সময় ধরে সরাসরি সূর্যের আলোতে থাকার ফলে ত্বকের উপর চাপ পড়ে। বিশেষ করে, দুপুর ১০টা থেকে ৪টা পর্যন্ত সূর্যের তাপ সবচেয়ে বেশি থাকে।
- ত্বকের রঙ: হালকা ত্বকের রঙের মানুষের মধ্যে সানবার্ন হওয়ার সম্ভাবনা বেশি, কারণ তাদের ত্বকে মেলানিনের পরিমাণ কম থাকে। মেলানিন UV রশ্মির বিরুদ্ধে প্রাকৃতিক সুরক্ষা প্রদান করে।
- সানস্ক্রীন ব্যবহার না করা: সঠিক (SPF) এসপিএফ যুক্ত সানস্ক্রীন ব্যবহার না করা সানবার্নের ঝুঁকি বাড়ায়। এটি অধিকাংশ মানুষের না জানার কারণে ঘটে।
- মেঘলা দিন: মেঘলা আবহাওয়াতে মানুষ সূর্যের রশ্মির প্রকৃত প্রভাব কম মনে করে। কিন্তু UV রশ্মি মেঘের মাধ্যমে প্রবাহিত হয় এবং ত্বকের ক্ষতি করতে পারে।
- অসাবধানতা: সূর্যের তাপ থেকে রক্ষা পাওার জন্য সঠিক পোশাক বা মাথায় টুপি ব্যবহার না করা।
এই কারণগুলো সানবার্নের ঝুঁকি বাড়ায় এবং ত্বককে ক্ষতিগ্রস্ত করে। সতর্কতা অবলম্বন করে এসব সমস্যা এড়ানো সম্ভব।
সানবার্নের লক্ষণ
সানবার্ন হলে ত্বকে বিভিন্ন লক্ষণ দেখা দেয় সানবার্নের প্রধান লক্ষণগুলো নিচে দেওয়া হলো:
- লালভাব: সানবার্নের প্রথম লক্ষণ হল ত্বকে লালচে ভাব দেখা যাওয়া। বেশি সময় সূর্যের রশ্মির সংস্পর্শে থাকার ফলে ত্বকের শিরা ফুটে ওঠে। যে কারণে ত্বকে উজ্জ্বল লালভাব দেখা দেয়।
- ব্যথা: ত্বক জ্বালাপোড়া করে এবং ব্যথা অনুভূত হয়। কিছু ক্ষেত্রে এটি খুব তীব্র হতে পারে, যা অনেক অস্বস্তি সৃষ্টি করে।
- ফোলাভাব: ত্বক সাধারণত ফুলে যায় এবং কিছু ক্ষেত্রে ছোট ছোট ফুসকুড়ি তৈরি হতে পারে।
- চুলকানি: সানবার্নের কারণে ত্বকে চুলকানি অনুভূত হয়, যা অস্বস্তি সৃষ্টি করে। চুলকানির মাত্রা অনেক বেশি হলে তা র্যাস সৃষ্টি করে এবং ত্বকের ক্ষতি করে।
- শুকনো ত্বক: সানবার্নের পর ত্বক শুকিয়ে যেতে পারে, যার ফলে খোসা ওঠার প্রবণতা বাড়ে। এটি একদিকে ত্বকের পুনরুদ্ধারের প্রক্রিয়া, অন্যদিকে অস্বস্তির কারণ।
- দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব: গুরুতর সানবার্নের ক্ষেত্রে ত্বকে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি হয়, যেমন বলিরেখা, ত্বকের টান এবং ক্যান্সারের ঝুঁকি বারে।
- মাথাব্যথা এবং জ্বর: কিছু ক্ষেত্রে সানবার্নের কারণে মাথাব্যথা, বমি বমি ভাব বা হালকা জ্বরও দেখা দিতে পারে।
সানবার্নের লক্ষণ দেখা দিলে অবিলম্বে সঠিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি। ত্বককে সুরক্ষিত রাখতে এবং অস্বস্তি কমাতে প্রয়োজনীয় যত্ন নিতে হবে।
সানবার্ন দূর করার উপায়
সানবার্ন হলে সঠিক যত্ন নেওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নীচে কিছু কার্যকরী উপায় উল্লেখ করা হলো:
ঠাণ্ডা পানিতে গোসল: সানবার্ন হলে প্রথম এবং সবচেয়ে সহজ প্রতিকার হল ঠাণ্ডা পানিতে গোসল করা। এটি ত্বকের তাপমাত্রা কমাতে এবং আরাম দিতে সাহায্য করে। ঠাণ্ডা পানিতে কিছু সময় কাটালে ত্বকে শান্ত এবং শীতল অনুভূতি পাওয়া যায়।
অ্যালোভেরা জেল: অ্যালোভেরা ত্বকের জ্বালাপোড়া এবং অস্বস্তি কমাতে খুবই কার্যকরি প্রাকৃতিক উপাদান। এটি ত্বকে প্রয়োগ করলে ত্বক হাইড্রেটেড থাকে এবং দ্রুত সুস্থ হতে সাহায্য করে। বাজারে পাওয়া অ্যালোভেরা জেল ব্যবহার করা যাবে তবে তাজা অ্যালোভেরা পাতা কেটে সরাসরি ত্বকে লাগালে আরও ভালো কার্যকারিতা পাওয়া যায়।
শুধু পানি পান করা: সানবার্নের সময় শরীরের পানি শূন্যতা দেখা দেয়। তাই প্রচুর পানি পান করা জরুরি। এটি ত্বককে হাইড্রেট রাখে এবং ত্বকের পুনরুদ্ধারে সাহায্য করে।
দুধের প্যাক: দুধের মধ্যে ল্যাকটিক অ্যাসিড থাকে, যা ত্বককে প্রশমিত করতে সাহায্য করে। এক কাপ দুধের সাথে কিছু বরফ মিশিয়ে একটি প্যাক তৈরি করুন এবং তা ত্বকে লাগান। এটি সানবার্নের লক্ষণ কমাতে সাহায্য করবে।
সানস্ক্রীন ব্যবহার: সানবার্নের প্রতিরোধের জন্য সানস্ক্রীন ব্যবহার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। SPF 30 বা তার বেশি এসপিএফ যুক্ত সানস্ক্রীন ব্যবহারের মাধ্যমে UV রশ্মির ক্ষতিকর প্রভাব থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। সানস্ক্রীন ব্যবহার করার সময় অবশ্যই ৩০ মিনিট আগে প্রয়োগ করুন এবং প্রতি দুই ঘণ্টা পরপর পুনরায় লাগান।
সানস্ক্রিন ও সান লোশন কি এক ও এটি কি কালো দাগ দূর করে
ত্বককে ময়েশ্চারাইজ করা: ত্বককে ময়েশ্চারাইজ রাখতে ভিটামিন ই তেল বা কোকোনাট অয়েল ব্যবহার করতে পারেন। এটি ত্বকের ময়েশ্চার লক করতে সাহায্য করে এবং পুনরুদ্ধারের প্রক্রিয়া দ্রুত করে।
অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি ঔষধ: সানবার্নের ব্যথা কমাতে আইবুপ্রোফেন বা ন্যাপ্রোকসেনের মতো অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি ঔষধ ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে, অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ব্যবহার করতে হবে।
রেহাইয়ের জন্য ঠাণ্ডা কম্প্রেস: ঠাণ্ডা কম্প্রেস তৈরি করতে কিছু বরফ একটি পরিষ্কার কাপড়ে জড়িয়ে ত্বকের ওপর প্রয়োগ করুন। এটি ত্বকের উত্তাপ কমাতে সাহায্য করে এবং আরাম দেয়।
ফল এবং সবজি: ফল ও সবজির মধ্যে তরমুজ, শসা এবং টমেটো ত্বককে হাইড্রেটেড রাখে এবং সানবার্নের প্রভাব কমাতে সাহায্য করে। এই ফলগুলির রস সরাসরি খাওয়া যেতে পারে।
ডাক্তারের পরামর্শ: যদি সানবার্নের লক্ষণ গুরুতর হয়, যেমন ত্বকে বড় ফুসকুড়ি, তীব্র ব্যথা বা জ্বর, তাহলে অবিলম্বে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে এবং সে অনুযায়ী চিকিৎসা করাতে হবে।
সানবার্ন প্রতিরোধের উপায়

সঠিক সতর্কতা পদ্ধতি অবলম্বন করে দ্রুত সানবার্ন এড়ানো সম্ভব। নীচে কিছু কার্যকরী প্রতিরোধের উপায় উল্লেখ করা হলো:
- সানস্ক্রীন ব্যবহার: SPF 30 বা তার বেশি এসপিএফ যুক্ত সানস্ক্রীন ব্যবহার করুন। বাইরে বের হওয়ার ৩০ মিনিট আগে সানস্ক্রীন লাগান এবং প্রতি দুই ঘণ্টা পর পর পুনরায় লাগান।
- ছায়ায় থাকা: বিশেষ করে সকাল ১০টা থেকে ৪টা পর্যন্ত সূর্যের আলো থেকে দূরে থাকুন। এই সময় সূর্যের UV রশ্মির তীব্রতা সবচেয়ে বেশি থাকে।
- সুরক্ষামূলক পোশাক: লম্বা হাতার জামা, প্যান্ট এবং হালকা রঙের পোশাক পরিধান করুন। এছাড়া, টুপি এবং সানগ্লাস ব্যবহার করুন। যা মাথা এবং চোখকে UV রশ্মি থেকে রক্ষা করবে।
- উচ্চ UV সূচক সময় সচেতনতা: যদি UV রশ্মির পরিমাণ অনেক বেশি হয়, তাহলে বাইরে যাওয়া এড়ানো উচিত। UV রশ্মির পরিমাণ সাধারণত স্থানীয় আবহাওয়া রিপোর্টে পাওয়া যায়।
- শিশুদের সুরক্ষা: শিশুদের ত্বক সূর্যের রশ্মির প্রতি বেশি সংবেদনশীল। তাদের জন্য বিশেষ সানস্ক্রীন এবং সুরক্ষামূলক পোশাক ব্যবহার করুন।
- সানবার্ন পরবর্তী যত্ন: সানবার্ন হলে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করুন। সানবার্নের লক্ষণ দেখা দিলে সতর্ক থাকুন এবং ত্বকের সঠিকভাবে যত্ন নিন।
- সূর্য রোধক উপকরণ: প্রয়োজন হলে, UV রোধক উপকরণ, যেমন ছাতা বা প্যারাসোল ব্যবহার করুন।
- অ্যালকোহল ও ধূমপান কমানো: অ্যালকোহল এবং ধূমপানের কারণে ত্বক আরো শুষ্ক হয়ে পড়তে পারে। তাই এসব থেকে দূরে থাকা ভালো।
- নিয়মিত ত্বকের পরীক্ষা: ত্বকের স্বাস্থ্য নিয়মিত পরীক্ষা করুন এবং কোন অস্বাভাবিকতা দেখা দিলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
উপসংহার
সানবার্ন একটি সাধারণ কিন্তু অস্বস্তিকর সমস্যা। তবে সানবার্ন দূর করার উপায় সঠিক ভাবে জেনে সঠিক যত্ন ও প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করলে এই সমস্যা থেকে সহজেই রক্ষা পাওয়া সম্ভব। সানবার্নের সময় সঠিক চিকিৎসা নেওয়া এবং পরবর্তীতে সঠিক সতর্কতা অবলম্বন করলে ত্বক সুস্থ রাখতে সাহায্য করবে। সর্বদা মনে রাখবেন, ত্বক আমাদের শরীরের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ, এবং এর যত্ন নেওয়া আমাদের দায়িত্ব।