আমাদের এই ব্যস্ত জীবনযাত্রায় চুল পড়া খুবই সাধারণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্তমানে তাই তো প্রায়ই নারী-পুরুষ উভয়েই টাক পড়ার সমস্যায় ভুগছেন। টাক পড়ার সমস্যার কারণে, প্রায় সকল মানুষেরই তাদের যৌবনে বৃদ্ধ দেখাতে শুরু করে। অনেক সময় ভুল লাইফস্টাইলের কারণেও মাথায় টাক পড়ার সমস্যা হয়ে থাকে। আবার অনেক সময় এই সমস্যাটি বংশগত ও হতে পারে।
হেয়ার ট্রান্সপ্লান্ট হল এমন একটি পদ্ধতি যার মধ্যে মাথার পিছন বা পাশ থেকে যেখানে ঘন চুল থাকে, আর যেখানে চুল নেই সেখানে লাগানো হয়। এই পুরো প্রক্রিয়াটি করতে কয়েক সপ্তাহ এর মতো সময় লাগে। এই সার্জারিতে টাক পড়ার সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া গেলেও মাঝে মাঝে এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ারও সম্মুখীন হতে হয়। আসুন আমরা এই নির্দেশিকায় হেয়ার ট্রান্সপ্লান্ট ভালো নাকি খারাপ? হেয়ার ট্রান্সপ্লান্ট করতে গেলে কেমন খরচ পড়ে? এবং এই সম্পর্কিত বিস্তারিত তথ্যগুলো জেনে নেই –
হেয়ার ট্রান্সপ্লান্ট ভালো নাকি খারাপ?
হেয়ার ট্রান্সপ্লান্ট এর সম্ভাব্য সুবিধাগুলির মধ্যে রয়েছে, যাদের মাথা টাক হয়ে গেছে তাদের হেয়ার ট্রান্সপ্লান্ট এর ফলে টাক কমে যায় অনেকক্ষেত্রে পুরো মাথায়ই চুল গজায় যার ফলে আত্মসম্মান অনেকটা উন্নত হয়। এছাড়াও হেয়ার ট্রান্সপ্লান্ট এর ফলে চুল পড়ার স্থায়ী সমাধান হয়। তবে এর সুবিধা থাকলেও এই সার্জারির যথেষ্ট পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে। যদিও হেয়ার ট্রান্সপ্লান্ট সার্জারির পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সাধারণত অস্থায়ী হয়। আপনি আপনার মাথার ত্বকে, ডোনার সাইট বা যেখানে নতুন চুল হয়েছে সেখানে নিম্নলিখিত সমস্যাগুলি অনুভব করতে পারেন:

- ক্রাস্ট বা স্ক্যাবস।
- চুলকানি।
- অনুভূতি হারানো।
- ব্যথা বা থরথর।
- ফোলা।
- নিবিড়তা।
এছাড়াও যেকোনো অস্ত্রোপচারের মতো, এটি একটি হেয়ার ট্রান্সপ্লান্ট ঝুঁকি নিয়ে আসে। এর মধ্যে রয়েছে:
- অ্যানেস্থেশিয়াতে অ্যালার্জির প্রতিক্রিয়া।
- অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ।
- ব্যর্থ গ্রাফ্ট বা ফ্ল্যাপ।
- সংক্রমণ।
- আপনার মাথার ত্বকে অনুভূতি হ্রাস।
- দাগ হওয়া ইত্যাদি ।
হেয়ার ট্রান্সপ্লান্ট এর ফলাফল কতক্ষণ স্থায়ী হয়?
যেকোনো হেয়ার ট্রান্সপ্ল্যান্টের সম্পূর্ণ ফলাফল দেখতে এক বছর পর্যন্ত সময় লাগতে পারে। গ্রাফ্ট বা ফ্ল্যাপ সেরে যাওয়ার সাথে সাথে ট্রান্সপ্লান্ট চুল পড়ে যেতে পারে। তবে এটাই স্বাভাবিক ব্যাপার। চুল আবার বেড়ে উঠতে হবে। একটি প্রাকৃতিক ও ভালো ফলাফল অর্জনের জন্য আপনাকে বেশ কয়েকটি নিয়ম অনুসারে হেয়ার ট্রান্সপ্লান্ট সার্জারির প্রয়োজন হতে পারে।
হেয়ার ট্রান্সপ্লান্ট করতে গেলে কেমন খরচ পড়ে?
হেয়ার ট্রান্সপ্লান্ট করতে গেলে কতটা অংশে ট্রান্সপ্ল্যান্ট হবে তার ওপরে খরচ নির্ভর করে। বাংলাদেশে হেয়ার ট্রান্সপ্লান্টের খরচ গ্রাফটের সংখ্যা, ব্যবহৃত কৌশল, ক্লিনিক এবং সার্জনের উপর নির্ভর করে।
তবে এটা বলা যায় যে, খরচ সাধ্যের মধ্যেই হয়। ভারতের তথ্যানুসারে,ফলিকিউলার ইউনিট ট্রান্সপ্ল্যান্টেশন (এফ ইউ টি)-র ক্ষেত্রে ক্লিনিক ভেদে ফলিকল পিছু খরচ ৪০-৫০ টাকা এবং ফলিকিউলার ইউনিট এক্সট্র্যাকশন (এফ ইউ ই)-র ক্ষেত্রে ফলিকল পিছু ৫০-৬০ টাকা। তবে সময়ে সময়ে বিভিন্ন চিকিৎসালয়ে এই হেয়ার ট্রান্সপ্লান্টের জন্য (১০-২০%)বিশেষ ছাড় দেওয়া হয়। তাই সময় বুঝে হেয়ার ট্রান্সপ্লান্ট করাতে পারলে খরচ তুলনামূলক অনেকটাই কমে যায়। মোটামুটি ভাবে ৫০০ থেকে ২,৫০০ ফলিকল প্রতিস্থাপিত হতে পারে। প্রতি ফলিকলে ১থেকে ৪টি চুল থাকে।
যাইহোক, সাধারণভাবে আপনি বাংলাদেশে চুল প্রতিস্থাপনের জন্য 50,000 টাকা থেকে 300,000 টাকার মধ্যে অর্থ প্রদানের আশা করতে পারেন৷
হেয়ার ট্রান্সপ্লান্ট করলে সারাজীবন কি এগুলো মাথায় থাকবে?
হেয়ার ট্র্যান্সপ্ল্যান্টের সুবিধে হল এই চুল স্থায়ী হয়। কারণ, এটি মানুষটির নিজেরই চুল, যা অন্য জায়গা থেকে প্রতিস্থাপিত করা হয়। এই চুলের ঘনত্ব খুবই ভাল হয়। চুল বাড়ে এবং এই চুল ইচ্ছামতো কাটা যায়। এমনকি মাথা ন্যাড়া করলেও চুল বেরিয়ে আসে।
এই চুলের প্রতিদিনের মতো শ্যাম্পু ব্যবহার করা যায়। আর এখন তো শুধু মাথা নয়, চিকিৎসকেরা ভুরু, গোঁফ, দাড়িতেও হেয়ার ট্রান্সপ্লান্ট করছেন। কারণ অনেকের ভুরুর চুল উঠে যায়। অনেকের গোঁফ ও থুতনির দাড়ির মাঝের অংশে চুল থাকে না। অনেক ছেলে আছে যারা ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি রাখতে চান। তাদের সেই অংশে দাড়ি ট্রান্সপ্লান্টও করা হয়।
যাঁরা হেয়ার ট্রান্সপ্লান্ট করাতে পারেন
সবাই হেয়ার ট্রান্সপ্লান্ট করাতে পারেন। তবুও মূলত ২৫ থেকে ৪০ বছরের পুরুষ ও মহিলার মধ্যে হেয়ার ট্রান্সপ্লান্ট বেশি হয়। মহিলাদের মধ্যে এমনিতেই ৩৫ বছরের পরে প্রিমেনোপজাল হেয়ার ফল হতে শুরু করে। তাই ৩০ এর মধ্যে মহিলাদের হেয়ার ট্রান্সপ্লান্ট একটি সাধারণ ঘটনা। অনেকের আবার অল্পবয়সে চুল পাতলা হয়ে যায়। বিশেষ করে বিয়ের আগে নিজেকে সুন্দর ও আকর্ষণীয় করে তুলতে মেয়েদের মাথা ভর্তি চুল থাকাটা অনেক প্রয়োজন। তরুণী মেয়েরা অনেকসময় ওই কারণেও হেয়ার ট্রান্সপ্লান্ট করান।
বড় ধরনের শারীরিক সমস্যা আছে যাঁদের তাঁদের হেয়ার ট্রান্সপ্লান্ট করার ক্ষেত্রে নানা সমস্যা হতে পারে। যেমন,
- যাঁদের অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস আছে,
- অ্যাঞ্জিওগ্রাফি করে স্টেন্ট বসানো হয়েছে,
- ভালভের সমস্যা আছে এবং নিয়মিত যাদের ওষুধ খেতে হয় তাঁদের হেয়ার ট্রান্সপ্লান্ট না করানোই ভাল।
এ ছাড়া অন্যান্য কোনও ক্ষেত্রেই হেয়ার ট্র্যান্সপ্ল্যান্ট করাতে কোনো প্রকার অসুবিধে নেই।
তবে সবার যে হেয়ার ট্র্যান্সপ্ল্যান্টের প্রয়োজন হয় এমন নয়। প্রথমে আগত মানুষটিকে প্রশ্ন করে বোঝার চেষ্টা করা হয় কেন তার চুল পড়ছে। এক্ষেত্রে দুটি ধারায় চিকিৎসা আছে-
- ওষুধ দিয়ে এবং
- হেয়ার ট্র্যান্সপ্ল্যান্ট করে।
যে-কোনও একটিকে অনুসরণ করে চিকিৎসা করা হয়। এতে চুলের সমস্যার সঠিক সমাধান পাওয়া যায়।
হেয়ার ট্রান্সপ্লান্ট সার্জারির পর পুনরুদ্ধারের প্রক্রিয়া কী?
বেশিরভাগ হেয়ার ট্রান্সপ্লান্ট হল বহিরাগত রোগীর সার্জারি, যার মানে আপনি এই সার্জারি করার পরে সেই দিনেই বাড়িতে যেতে পারেন। আপনার চুলকে পুনরুদ্ধারের প্রক্রিয়া আপনার ট্রান্সপ্লান্টের ধরণের উপর নির্ভর করে। সার্জারির পরের দিনগুলিতে, আপনি যে কাজগুলো করবেন :

- দিন ১:আপনার মাথা হতে ব্যান্ডেজ সরান।
- দিন ২: আপনার চুল ধুয়ে নিন।
- দিন ৩ থেকে ৫: কাজে ফিরে যান এবং হালকা কার্যকলাপ শুরু করুন।
- ১০ দিন পর: সেলাই অপসারণ করুন (যার কাছে আপনার সার্জারি করা হয়েছে)।
- ৩ সপ্তাহ পরে: পুনরায় ব্যায়াম বা খেলাধুলায় ফিরে যান।
হেয়ার ট্রান্সপ্লান্টের দীর্ঘমেয়াদী ফলাফলের উপর কোন কারণগুলি প্রভাব ফেলে?
হেয়ার ট্রান্সপ্লান্টের সাফল্য এবং ফলাফল নির্ধারণে অনেকগুলো কারণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসুন সেগুলো জেনে নেই –
সার্জনের দক্ষতা
আপনার সার্জনের দক্ষতা এবং অভিজ্ঞতা শুধুমাত্র চুল ট্রান্সপ্লান্টের জীবনকালই নয়, এই চুলগুলিকে কতটা স্বাভাবিক দেখায় তা প্রভাবিত করে। আপনার এমন একজন সার্জন বেছে নেওয়া উচিত যিনি চুল পড়ায় বিশেষজ্ঞ, চর্মবিদ্যা এবং চুল প্রতিস্থাপনের বিষয়াদি সম্পর্কে যথেষ্ট অভিজ্ঞতাসম্পন্ন।
একটি স্বনামধন্য ক্লিনিক
ভাল খ্যাতি সহ একটি ক্লিনিক বাছাই করুন যা জীবাণুমুক্ত, পরিষ্কার এবং ভালো চিকিৎসা প্রদান করে।
ডোনার এলাকা
আপনার ডোনার এলাকা থেকে বের করা চুলের ফলিকলের স্বাস্থ্য এবং গুণমান প্রক্রিয়াটির সাফল্যকে প্রভাবিত করে।
অস্ত্রোপচার-পরবর্তী যত্ন
আপনাকে হেয়ার ট্রান্সপ্ল্যান্টের পরে অনুসরণ করার নির্দেশনা দেওয়া হয় যা নিরাময়ে সাহায্য করে এবং সর্বোত্তম ফলাফলে উল্লেখযোগ্যভাবে অবদান রাখে। এতে আপনার চুল কীভাবে ধুতে হবে, কখন ব্রাশ করতে হবে, কোন পণ্য ব্যবহার করতে হবে এবং অন্যান্য টিপস অনুসরণ করার মতো বিষয়গুলি অন্তর্ভুক্ত থাকে।
যদি চুলের বৃদ্ধির অন্যান্য চিকিৎসা আপনার জন্য কাজ না করে তাহলে হেয়ার ট্রান্সপ্লান্ট সার্জারি একটি বিকল্প হতে পারে। হেয়ার ট্রান্সপ্লান্ট এর বিভিন্ন কৌশল রয়েছে। তাই ,আপনার লক্ষ্যগুলি সর্বোত্তমভাবে পূরণ করবে এমন পদ্ধতি বেছে নেওয়ার জন্য একজন স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীর সাথে কাজ করা গুরুত্বপূর্ণ।
চুল পড়া এবং চুল পুনরুদ্ধারের অভিজ্ঞতা সহ একজন দক্ষ পেশাদারের সন্ধান করুন এবং শুধুমাত্র তাদেরই ট্রান্সপ্লান্ট সার্জারি গ্রহণ করুন। আশা করি আমাদের এই নির্দেশিকায় হেয়ার ট্রান্সপ্লান্ট ভালো নাকি খারাপ?হেয়ার ট্রান্সপ্লান্ট করতে গেলে কেমন খরচ পড়ে ইত্যাদি নানা বিষয়ে বিস্তারিত ধারণা পেয়েছেন।