লেবু হলো ভিটামিন C সমৃদ্ধ একটি ফল। ছোট্ট এই ফলটির উপকারিতা জানলে আপনি অবাক হবে। গরমের দিনে এক গ্লাস লেবুর শরবত খেলেই যেমন আপনার তৃষ্ণা দূর করা সম্ভব ঠিক তেমনি রূপচর্চা তেও লেবুর ব্যবহারে আপনার সুন্দর ত্বক ও চুল পাওয়া সম্ভব।
আমরা রূপচর্চা বলতে শুধুই রাসায়নিক উপাদান মিশ্রিত কসমেটিক প্রসাধনী কে বুঝি থাকি । অথচ প্রাকৃতিক উপাদান দিয়েও রূপচর্চা করা সম্ভব। প্রাকৃতিক উপাদানে রূপচর্চা সম্পূর্ণ নিরাপদ এবং কার্যকরী। আজকের এই লেখায় আমরা জানাবো রূপচর্চায় লেবুর ব্যবহার সম্পর্কে ।
ত্বকের যত্নে লেবু
ত্বকের যত্নে আমরা ময়েশ্চারাইজার, ফেসওয়াশ , সিরাম, সুথিং জেল সহ নানা কসমেটিকস উপাদান ব্যবহার করে থাকি। তবে ত্বকের বাড়তি যত্নের জন্য আপনি চাইলে ফেসপ্যাকের সাথে লেবু মিশিয়ে ব্যবহার করতে পারেন। ত্বকের যত্নে বহুযুগ থেকেই এই লেবুর ব্যবহার প্রচলিত।
ব্রণ দূর করে
অনেক সময় জীবানুর আক্রমণের কারনে আমাদের ত্বকে ব্রণের সৃষ্টি হয়। ত্বকে ব্রণের কারনে আমাদের সৌন্দর্য নষ্ট হয়ে থাকে। লেবু তে রয়েছে অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল উপাদান। ত্বকে লেবুর ব্যবহারে এটি আমাদের ত্বক কে ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়ার হাত থেকে রক্ষা করে। ব্রণ দূর করার জন্য লেবুর সাথে মধু মিশিয়ে ব্রণের উপরে ব্যবহার করতে পারেন। এছাড়া লেবুর রসের সাথে সামান্য আলুর রস মিশিয়েও এটি ত্বকে ব্যবহার করতে পারেন। এতে করে ব্রণের পাশাপাশি ত্বকের কালো দাগ ও কমতে শুরু করবে।
রোদে পোড়া ভাব দূর করে
সানট্যান বা রোদে পোড়া ভাব আমাদের সৌন্দর্য নষ্টের পিছনে বড় একটি কারন। সানট্যান এর কারনে আমাদের ত্বকের উজ্জ্বলতা নষ্ট হতে থাকে। তবে ত্বকের সানট্যান কমানোর জন্য লেবুর ব্যবহার করতে পারেন। এক চামচ মধু, সামান্য বেসন এর সাথে লেবুর রস মিশিয়ে প্যাক তৈরি করে এটি ত্বকে ব্যবহার করতে পারেন। এতে করে ট্যান দূর হবে। এছাড়া বেসন, সামান্য হলুদ গুড়া ও লেবু মিশিয়েও ত্বকে ব্যবহার করলে রোদে পোড়া ভাব কমে যাবে।

ত্বকের বলিরেখা দূর করে
বয়সের সাথে সাথে আমাদের ত্বকের বলিরেখা বাড়তে থাকে সেই সাথে অনেক সময় সূর্যের ক্ষতিকর রশ্মির কারনেও আমাদের ত্বকে বলিরেখার রিমান বেড়ে যায়। এই সমস্যা থেকে মুক্তির জন্য ত্বকে সামান্য লেবুর রস ব্যবহার করতে পারবেন। আলুর রস ও লেবু আমাদের ত্বকের বলিরেখা কমাতে দারুণ কার্যকরী। তাই আলুর রসের সাথে লেবু মিশিয়ে ত্বকে ব্যবহার করতে পারেন। ১০ মিনিট রাখার পরে ত্বক পরিষ্কার করে একটি ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার করে নিবেন।
ত্বকের উজ্বলতা বৃদ্ধি করে
লেবু তে রয়েছে ভিটামিন C-এটি আমাদের ত্বক কে উজ্জ্বল রাখতে সাহায্য করে। ত্বকের সৌন্দর্য বৃদ্ধিতে লেবু খাওয়ার পাশাপাশি ত্বকে ব্যবহার করতে পারেন। এমন বেশ কিছু ফেসপ্যাক রয়েছে যেটি নিয়মিত ব্যবহারে ত্বকের উজ্জ্বলতা বৃদ্ধি করা সম্ভব। এমন ৫ টি উপকারি ফেসপ্যাক সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক –
ফেসপ্যাক ১ঃ মধু এবং লেবু তে থাকা অ্যান্টিব্যাটেরিয়াল উপাদান আমাদের ত্বক কে জীবাণুর হাত থেকে সুরক্ষা প্রদান করে। এছাড়া এই দুইটি উপাদানই আমাদের ত্বকের উজ্জ্বলতা বৃদ্ধি করে। সপ্তাহে ২-৩ দিন মধুর সাথে লেবুর রস মিশিয়ে পরিষ্কার ত্বকে ব্যবহার করতে পারেন। ১ মাসেই ত্বকের উজ্জ্বলতা নিজ চোখে লক্ষ্য করবেন।
ফেসপ্যাক ২ঃ এই প্যাক টি তৈরি জন্য আমাদের প্রয়োজন এক চা চামচ বেসন, হাফ চা চামচ মধু, ২-৩ ফোটা লেবুর রস, এক চিমটি হলুদ গুড়া এবং গোলাপ জল। সব গুলো উপকরণ একসাথে মিক্সড করে মুখের ত্বক ও গলায় ব্যবহার করুন। ১০/১৫ মিনিট পরে মুখটি পরিষ্কার করে নিন। দেখবেন ত্বক অনেক বেশি ফ্রেশ দেখাচ্ছে।
ফেসপ্যাক ৩ঃ এক চা চামচ মুলতানি মাটি, হাফ চা চামচ চন্দন গুঁড়া, সেই সাথে লেবুর রস অথবা হাফ চা চামচ লেবুর খোসা বাটা মিশিয়ে ত্বকে ব্যবহার করতে পারেন। সপ্তাহে এক থেকে দুই দিন ব্যবহারেই এটি আপনার ত্বকের উজ্জ্বলতা বৃদ্ধি করবে।
ফেসপ্যাক ৪ঃ ডিমের সাদা অংশের সাথে হাফ চা চামচ লেবুর রস মিশিয়ে একটি প্যাক তৈরি নিতে পারেন। এরপর এটি পরিষ্কার ত্বকে ব্যবহার করে ১৫ মিনিট পরে ধুয়ে ফেলবেন। এটি আমাদের ত্বক টানটান রাখতে এবং ত্বকের উজ্বলতা বৃদ্ধিতে সাহায্য করবে।
ফেসপ্যাক ৫ঃ আলুর রস, শশা রস , ও লেবুর রস একত্রে মিশিয়ে ত্বকে ব্যবহারের ফলে ত্বকের সজিবতা ও উজ্জ্বলতা বজায় থাকে।
চুলের যত্নে লেবুর ব্যবহার
চুলে যত্নে পার্লারে গিয়ে কেরাটিন ট্রিটমেন্ট, স্পেশাল প্রোটিন ট্রিটমেন্ট, স্পা সহ ইত্যাদি না করেও আপনি হাতের কাছে থাকা কিছু প্রাকৃতিক উপাদানেই খুব সহজে চুলের যত্ন নিতে পারেন। ঠিক তেমনি একটু উপকরণ হলো লেবু। লেবু তে রয়েছে ভিটামিন সি, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট উপাদান, সাইট্রিক অ্যাসিড যা আমাদের ত্বক ও চুলের যত্নে কার্যকরী। চুলের যত্নে লেবুর ব্যবহারের মাধ্যমে আপনি খুশকি মুক্ত ঘন ও উজ্জ্বল চুল পেতে পারেন।
লেবুর রস ও মেহেদি গুড়া ও ডিম- মেহেদি গুড়া আমাদের চুলের গোড়া মজবুত রাখতে সাহায্য করে। চুলের পরিমান অনুযায়ী মেহেদি গুড়া নিয়ে তাতে একটি ডিমের সাদা অংশ ও ১ চা চামচ লেবুর রস মিশিয়ে চুলে ব্যবহার করলে এটি আপনার চুলের গোড়া মজবুত রাখার পাশাপাশি আপনার চুলের উজ্জ্বলতা বৃদ্ধি করবে।
লেবুর রস ও চায়ের লিকার- এক কাপ গরম পানিতে ৩-৪ টেবিল চামচ চা পাতা জ্বাল করে নিতে হবে। যখন এটি ঘন লিকারে পরিণত হবে তখন এটির সাথে লেবুর রস মিশিয়ে চুলে ব্যবহার করতে হবে। বিশেষ করে মাথার স্কাল্পে ব্যবহার করতে হবে। এতে করে খুশকি দূর হয়।
লেবুর রস, ক্যাস্টর ওয়েল ও নারকেল তেল– ২ চামচ নারকেল তেল, এক চামচ ক্যাস্টর ওয়েলের সাথে লেবুর রস মিশিয়ে এটি পুরো চুলে ব্যবহার করুন। ১ ঘন্টা পর শ্যাম্পু করে ফেলুন। এতে করে চুল মজবুত হওয়ার পাশাপাশি চুলের দ্রুত বৃদ্ধি ও নিশ্চিত হবে।
অ্যাপেল সিডার ভিনেগার ও লেবুর রস- খুশকি দূর করার জন্য এটি বেশ উপকারি। ৪ টাবিল চামচ ভিনেগার এর সাথে ২ টেবিল চামচ লেবুর রস মিশিয়ে এটি মাথার স্কাল্পে ব্যবহার করতে পারেন। সপ্তাহে ১ থেকে দুই দিন ব্যবহারেই খুশকির সমস্যার দ্রুত সমাধান পাবেন।

নখের যত্নে লেবু
লেবু আমাদের নখের উজ্জ্বলতা বৃদ্ধি করে সেই সাথে নখ পরিষ্কার রাখতে সাহায্য করে। হাত পায়ের নখের কালচে ভাব দেখা দিলে নখের খোসা সহ লেবুর রস ঘষতে পারেন। এতে করে নখের কালোভাব দূর হতে থাকবে। এছাড়া মেনিকিউর ও পেডিকিউর করার ক্ষেত্রে লেবুর সর্বাধিক ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়।
কনুই এর কালো দাগ দূর করে
আমাদের অনেকেরই শরীরের তুলনায় হাত বা পায়ের কনুই অনেক বেশি কালো হয়ে যায়। এই কালচে ভাব আমাদের হাত পায়ের সৌন্দর্য নষ্ট করে। তাই এই কালোভাব দূর করার জন্য খোসাসহ লেবুর সাথে সামান্য হলুদ গুড়া মিশিয়ে কনুই এ ম্যাসাজ করবেন। নিয়মিত ব্যবহারে কালো দাগ ধীরে ধীরে কমতে শুরু করবে।
দাঁতের উজ্বলতা বৃদ্ধি করে
সাদা উজ্জ্বল দাঁত আমাদের সকলেরই অনেক পছন্দের। আর এই দাঁত সাদা করার জন্য লেবুর রসের ব্যবহার অনেক কার্যকরী। লেবুর রসের সাথে সামান্য বেকিং সোডা মিশিয়ে দাঁতে ব্যবহারের ফলে এটি দাঁত পরিষ্কার ও সাদা রাখতে সাহায্য করে।
ঠোঁটের যত্নে
সূর্যের ক্ষতিকর রশ্মির কারণে , কম দামি লিপস্টিক এর ব্যবহার অথবা ধূমপানের কারনে অনেক সময় আমাদের ঠোটে কালো দাগের সৃষ্টি হয়। ঠোঁটের কালো দাগ দূর করার জন্য চিনির সাথে লেবুর রস মিশিয়ে ঠোটে স্ক্রাব করতে পারেন। এতে ঠোঁটের মরা চামড়া দূর হবে এবং ঠোটে গোলাপি ভাব আসবে।
রূপচর্চায় লেবুর রস ব্যবহারে সতর্কতা
লেবুর রস আমাদের ত্বক ও চুলের জন্য উপকারি হলেও এটি ব্যবহারে আমাদের সতর্ক হওয়া উচিত।
- শুধু লেবুর রস কখনোই সরাসরি ত্বকে বা চুলে ব্যবহার করা যাবে না। অবশ্যই লেবুর রসের সাথে অন্য কোনো উপকরন মিশিয়ে ব্যবহার করতে হবে।
- ত্বকে বা চুলে লেবুর রস ব্যবহারের সময় সূর্যের স্পর্শে আসা যাবে না এবং বাহিরে বের হলে অবশ্যই সানস্ক্রিন ব্যবহার করতে হবে।
- অতিরিক্ত পরিমানে লেবুর রস ব্যবহার করা যাবে না।
- লেবুর রস ব্যবহারের পর অ্যালার্জি বা র্যাশ অনুভব করলে এটি ব্যবহার থেকে বিরত থাকতে হবে।
- চোখের নিচের ত্বকে কখনোই লেবুর রস ব্যবহার করবেন না।
রান্নাঘরের খুবই পরিচিত এই লেবু আমাদের শরীরের পাশাপাশি সৌন্দর্য রক্ষার ক্ষেত্রেও বিশেষ উপকারি। আশা করছি আজকের এই লেখার মাধ্যমে আপনি খুব সহজেই ঘরে বসেই কীভাবে রূপচর্চায় লেবুর ব্যবহার করবেন সেই বিষয়ে জেনেছেন। সবাই সুস্থ ও সুন্দর থাকুন।