চুল মানুষের সৌন্দর্য বহন করে। কিন্তু এই চুল নিয়ে সকলেরই চিন্তার শেষ নেই। কেননা জীবনযাত্রার ছন্দ,প্রাকৃতিক তেলের ভারসাম্যহীনতা,ও পারিপার্শ্বিক পরিবেশের ফলে চুলকে টিকিয়ে রাখা এখনকার দিনে খুব কঠিন হয়ে পড়েছে। ফলে বিভিন্ন রাসায়নিক উপাদান ব্যবহার করা ও দিন দিন বেড়েই চলছে।
আর এজন্যই চুল রক্ষা তো দূরের কথা আরো ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে। চুল ভেঙে যাচ্ছে,নিস্তেজ ও রুক্ষ হয়ে যাচ্ছে। তবে সহজ কিছু যত্ন নেয়ার ধরণেই রুক্ষ, ভঙ্গুর চুল এমন একটি জিনিস যা আমরা সবাই এড়াতে পারি।আসুন রুক্ষ চুলের যত্ন নেয়ার উপায়গুলো জেনে নেই –
চুল কেন রুক্ষ হয় ?
যখন চুল পর্যাপ্ত আর্দ্রতা পায় না বা আর্দ্রতা ধরে রাখে না তখন চুল রুক্ষ হয়। এটি চুল এর চকচকে ক্ষমতা হ্রাস করে এবং ঘোলাটে করে ফলে চুল এর উজ্জ্বলতা নষ্ট হয় এবং নিস্তেজ দেখায়। রুক্ষ চুল যেকোনো বয়সের পুরুষ এবং মহিলাদের প্রভাবিত করতে পারে। তবে এটি আপনার বয়স বাড়ার সাথে সাথে হওয়ার সম্ভাবনা বেশি দেখা যায়।
সাধারণত আমাদের চুল তিনটি স্তর দিয়ে গঠিত।যদি আপনার চুল স্বাস্থ্যকর হয় ,তবে বাইরের স্তরে থাকা প্রাকৃতিক তেল ভেতরের স্তরকে রক্ষা করতে সাহায্য করে। এগুলি আলোকে প্রতিফলিত করতে পারে এবং আপনার চুলকে চকচকে দেখায়।
উজ্জ্বল এবং দীপ্তি স্বাস্থ্যকর চুলের দুটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষণ। চুল শুকিয়ে গেলে, বাইরের স্তর ভেঙ্গে যায়। আর এভাবেই চুল রুক্ষ হয় যার ফলে এটি নিস্তেজ এবং অস্বাস্থ্যকর দেখায়।
রুক্ষ চুলের কারণ
পরিবেশগত অবস্থা, চুলের যত্নের অভ্যাস এবং আপনার শারীরিক স্বাস্থ্য সহ বিভিন্ন কারণে আপনার চুল রুক্ষ হতে পারে।

রুক্ষ চুলের কারণ হতে পারে এমন কিছু পরিবেশগত অবস্থার মধ্যে রয়েছে:
- একটি শুষ্ক, গরম জলবায়ুতে বসবাস
- রোদ বা বাতাসে দীর্ঘ সময় কাটানো
- ঘন ঘন ক্লোরিনযুক্ত বা লবণাক্ত পানিতে সাঁতার কাটা
যে অভ্যাসগুলি প্রায়শই চুল রুক্ষ করতে অবদান রাখে:
- আপনার চুল খুব ঘন ঘন ধোয়া
- রাসায়নিক শ্যাম্পু, কন্ডিশনার বা স্টাইলিং পণ্য ব্যবহার করা
- রাসায়নিকভাবে আপনার চুল এর চিকিৎসা করা
- নিয়মিত আপনার চুল ব্লো-ড্রাই করা
- বৈদ্যুতিক কার্লিং আয়রন, স্ট্রেইটনার বা কার্লার ব্যবহার করা
আবার কিছু ক্ষেত্রে, রুক্ষ চুল একটি স্বাস্থ্য সমস্যার ফলাফল হয়ে দাঁড়ায়। যা আপনার চুলের আর্দ্রতা ধরে রাখার ক্ষমতাকে প্রভাবিত করে। যেমনঃ
অ্যানোরেক্সিয়া নার্ভোসা
এটি একটি খাওয়ার ব্যাধি বা রোগ । অ্যানোরেক্সিয়া নার্ভোসা অপুষ্টির কারণে হতে পারে। এটি আরও গুরুতর জটিলতার পাশাপাশি রুক্ষ এবং ভঙ্গুর চুলের কারণ হতে পারে।
হাইপোপ্যারাথাইরয়েডিজম
আপনার হাইপোপ্যারাথাইরয়েডিজম থাকলে, আপনার ঘাড়ের প্যারাথাইরয়েড গ্রন্থি খুব কম প্যারাথাইরয়েড হরমোন তৈরি করে, যা আপনার রক্তে ক্যালসিয়ামের মাত্রা হ্রাস করে। ক্যালসিয়াম স্বাস্থ্যকর চুল, সেইসাথে হাড়, দাঁত এবং অন্যান্য টিস্যুর জন্য একটি মূল পুষ্টি।
হাইপোথাইরয়েডিজম
হাইপোথাইরয়েডিজমের সাথে, আপনার থাইরয়েড গ্রন্থিগুলি পর্যাপ্ত থাইরয়েড হরমোন তৈরি করে না। শুষ্ক এবং ভঙ্গুর চুল এই অবস্থার প্রাথমিক লক্ষণগুলির মধ্যে একটি।
মেনকেস সিনড্রোম
আপনার যদি মেনকেস সিনড্রোম থাকে, একটি বিরল জেনেটিক অবস্থা, আপনার কোষগুলি পর্যাপ্ত কপার শোষণ করে না। কম কপার শোষণ আপনার চুলের স্বাস্থ্যকে প্রভাবিত করে ফলে রুক্ষতার সৃষ্টি করে।
চুলের রুক্ষতা দূর করার উপায়
আপনি আপনার সাধারণ জীবনধারা পরিবর্তনের মাধ্যমে চুলের সঠিক যত্ন করতে পারেন। যা আপনার চুলের রুক্ষতা দূর করবে। এখানে কয়েকটি আপনি চেষ্টা করতে পারেন :
- প্রতিদিন চুলে শ্যাম্পু করা থেকে বিরত থাকুন।
- প্রতিবার চুল ধোয়ার সময় কন্ডিশনার ব্যবহার করুন।
- আপনার চুলের ধরন অনুযায়ী নির্বাচন করে শ্যাম্পু এবং কন্ডিশনার ব্যবহার করুন।
- চুলের সঠিক ময়েশ্চারাইজ করে এমন ধরনের ময়েশ্চারাইজিং পণ্য ব্যবহার করুন।
- রাসায়নিকভাবে চুলের চিকিৎসা এড়িয়ে চলুন।
- আপনার চুল কম করে ঘন ঘন ব্লো-ড্রাই করুন।
- ফ্ল্যাট আয়রন, কার্লিং আয়রন এবং বৈদ্যুতিক রোলার এড়িয়ে চলুন।
- প্রতিদিন শ্যাম্পু করা আপনার চুলের সুরক্ষামূলক তেল কেড়ে নিতে পারে এবং শুষ্কতার দিকে নিয়ে যেতে পারে। পরিবর্তে সপ্তাহে একবার বা দুবার আপনার চুল ধোয়ার চেষ্টা করুন।
- দীপ্তি এবং কোমলতা যোগ করতে আপনি চুলে তেল বা লিভ-ইন কন্ডিশনারও লাগাতে পারেন।
- তাপ এবং সূর্যের অতিরশ্নি থেকে আপনার চুল রক্ষা করুন।
- একটি পুল বা সমুদ্রে সাঁতার কাটার সময় গোসলের ক্যাপ পরে আপনার চুলকে ক্লোরিন এবং নোনা জল থেকে রক্ষা করুন।
আর যদি একটি অন্তর্নিহিত চিকিৎসা সমস্যা আপনার রুক্ষ চুলের কারণ হয়ে থাকে, তাহলে ডাক্তারের সাথে দ্রুত যোগাযোগ করুন।
চুলের রুক্ষতা দূর করতে ঘরোয়া প্যাক
ঘরে থাকা নানা উপাদান দিয়ে চুলের যত্ন নেয়া যায়। আপনার চুলের রুক্ষতা দূর করতে নিচের এই পদ্ধতিতে প্যাক তৈরি করে চুলের যত্ন নিতে পারেন।
উপাদানঃ
- টক দই
- অ্যালোভেরা জেল
- ডিমের সাদা অংশ
- নারিকেল তেল
- কন্ডিশনার
- লেবুর রস
পদ্ধতিঃ
একটি পাত্রে ডিমের সাদা অংশ নিন। তাতে এক চা চামচ নারিকেল তেল দিন , দেড় চা চামচ টক দই দিন , এক চা চামচ অ্যালোভেরা জেল দিন , আধা চা চামচ লেবুর রস এবং আধা চা চামচ কন্ডিশনার দিয়ে ব্লেন্ডারে ব্লেন্ড করে নিন ৷ তবে হাতে নাড়িয়ে মেশালেও হবে। তারপরে লাগিয়ে আধা ঘণ্টা বা এক ঘণ্টা পর ধুয়ে নিন ৷ এরপর শ্যাম্পু করুন। সর্বশেষে কন্ডিশনার ব্যবহার করবেন ৷ এটি সপ্তাহে একবার করবেন।তারপর ফলাফল নিজেই দেখতে পাবেন।
রুক্ষ চুলকে সিল্কি করার উপায়
আমরা ঘরোয়া পদ্ধতিতে আমাদের চুলকে সিল্কি করতে পারি খুবই সহজ এবং অল্প টাকা খরচ করে। শুধু তাই নয় এই ঘরোয়া উপায়গুলি আমাদের চুলকে প্রাকৃতিক ভাবে সিল্কি করে থাকে। যার কোন পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া থাকেনা। আসুন জেনে নেই চুলকে সিল্কি করার কিছু সহজ উপায় –

অ্যালোভেরা দিয়ে চুল সিল্কি করার উপায়
অ্যালোভেরার মধ্যে প্রোটিওলাইটিক এনজাইম থাকে। এটি আমাদের মাথার ত্বকে অবস্থিত মৃত কোষগুলিকে সরিয়ে দেয় এবং পুনরায় নতুন কোষ উৎপন্ন করতে সাহায্য করে। নিয়মিত অ্যালোভেরার ব্যবহার আমাদের চুলের গোড়াকে শক্ত করে এবং ভেঙে যাওয়া চুলগুলিকে পুনরায় মেরামত করে। নিয়মিত অ্যালোভেরা ব্যবহার আমাদের শুষ্ক এবং রুক্ষ চুলকে সিল্কি করতে সাহায্য করে।
ব্যবহারবিধি
অ্যালোভেরা গাছের পাতা থেকে অ্যালোভেরা জেল সংগ্রহ করে নিন। দুই চামচ নারকেল তেলের সাথে এটি মেশান। এরপর পুরো চুলে ভালোভাবে লাগান এবং ৩০ মিনিট রাখুন। প্রতি সপ্তাহে দুইবার ব্যবহার করতে পারেন। তারপর শ্যাম্পু ব্যবহার করে চুল ধুয়ে নিতে হবে।
ডিম দিয়ে চুল সিল্কি করার উপায়
ডিমের মধ্যে প্রচুর পরিমাণ প্রোটিন এবং নিউট্রিশন থাকে। তাই যদি নিয়মিত চুলে ডিম প্রয়োগ করা যায় তাহলে চুলের গোড়া অনেক বেশি শক্ত হয়। চুল খুব তাড়াতাড়ি বৃদ্ধি পায় এবং অনেক বেশি উজ্জ্বল আর সিল্কি হয়। শুধু তাই নয় নিয়মিত আমাদের চুলে ডিম ব্যবহার করলে তা ভেঙ্গে যাওয়া বন্ধ হয় এবং প্রাকৃতিক ভাবে মেরামত হয়।
ব্যবহারবিধি
প্রতি সপ্তাহে এক থেকে দুই দিন একটি ডিমকে সরাসরি আপনার চুলে প্রয়োগ করতে পারেন ৩০ মিনিটের জন্য। তারপর শ্যাম্পু দিয়ে দিয়ে আপনার চুল ধুয়ে নিতে হবে।
কলা দিয়ে চুল সিল্কি করার উপায়
পাকা কলার মধ্যে প্রচুর পরিমাণ জৈব তেল থাকে। এর মধ্যে পটাশিয়াম এবং ভিটামিন ও পাওয়া যায়। যা আমাদের চুলের শুষ্ক এবং রুক্ষ ভাব কে দূর করতে সাহায্য করে । আমাদের চুলের গোড়া শক্ত করে এবং চুল পড়ে যাওয়ার প্রবণতা হ্রাস করে। তাই নিয়মিত পাকা কলার ব্যবহার আপনার চুলের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
ব্যবহারবিধি
একটি সম্পূর্ণ পাকা কলা কে ভালোমতো পিষিয়ে নিন। এতে দুই চামচ মধুর সাথে মেশান। এবার ৩০ মিনিটের জন্য আপনার চুলে দিয়ে রাখেন । তারপর শ্যাম্পু ব্যবহার করে আপনার চুল ভালো মতো ধুয়ে ফেলুন।
সঠিক ও যথাযথ যত্ন নেয়াই পারে আপনার চুলকে কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে পৌঁছাতে।তাই আপনার চুলকে যথেষ্ট সময় দিন। আশা করি উপরের টিপস গুলা আপনার রুক্ষ চুলের যত্ন নিতে সহায়ক হবে।