অ্যালোভেরা এমন একটি উদ্ভিদ যেটি ১৭৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে হাজার হাজার বছর ধরে ব্যবহার করা হয়েছে। পৃথিবীতে অ্যালোভেরার ৪৫০ টিরও বেশি প্রজাতি রয়েছে। এটি একটি রসালো উদ্ভিদ যা সারা বিশ্বের উষ্ণ এবং শুষ্ক জলবায়ুতে জন্মায়। একে বহুজীবি ভেষজ উদ্ভিদ বলে আখ্যায়িত করা হয়। দেখতে অনেকটাই আনারস গাছের মতো। এর পাতাগুলো পুরু ও হালকা চওড়া হয়।
পাতার দুইধারে কাঁটা থাকে এবং ভিতরে পিচ্ছিল জেলের মতো শাঁস থাকে। মূলত এই শাঁসই জেল হিসেবে ব্যবহার করা হয়, ত্বকে, চুলে এবং নানা রোগ নিবারণের ওষুধ হিসেবে। এটি পানীয় হিসেবেও খাওয়া হয়। নানা পুষ্টিগুণে সম্পূর্ণ এই অ্যালোভেরা চুলের যত্ন নিতে বেশ জনপ্রিয়। চুলের যত্নে এটির নানাবিধ ব্যবহার রয়েছে। এবার আসুন এই নির্দেশিকাতে সেগুলা সম্পর্কে জেনে নেই –
অ্যালোভেরা কোথায় পাবেন
অ্যালোভেরা পাওয়া মোটামুটি অনেক সহজ। আপনি যদি একটি রৌদ্রোজ্জ্বল, ও শুষ্ক জলবায়ুতে বাস করে থাকেন। তাহলে আপনার উঠোনে বা বাসার পাশেই মাঠে এটি চাষাবাদ করা কোনো ব্যাপারই না।
সচরাচর অনেকেই এখন অ্যালোভেরা চাষ করে ব্যাবসা করে আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছে। আবার রাস্তায় বেরোলে অনেক ঔষধি ও প্রাকৃতিক জুস এর ভ্রাম্যমাণ দোকান দেখতে পাওয়া যায়,সেখানে অ্যালোভেরা পাতা দেখতে পাবেন।
আপনি চাইলে এসব প্রাকৃতিক খাবারের দোকানে গিয়ে অ্যালোভেরার পাতা কিনতে পারেন। খাঁটি অ্যালোভেরা জেল পাওয়ার সর্বোত্তম উপায় হল তাজা পাতা থেকে নিজেই এটি বের করা। পাতা থেকে জেল বের করতে আপনার যা দরকার তা হল একটি ছুরি ও একটি বাটি।
একবার আপনি পাতার ভিতর থেকে তাজা জেলটি বের করার পরে, আপনি জেলটিকে একটি সিল করা পাত্রে সংরক্ষণ করতে পারেন এবং এটি এক সপ্তাহ পর্যন্ত ফ্রিজে রাখতে পারেন। অথবা আপনি এটি হিমায়িত করতে পারেন যাতে এটি দীর্ঘস্থায়ী হয়।
আপনি যদি অ্যালোভেরার পাতা খুঁজে না পান বা নিজেই জেলটি বের করতে না চান ,তবে ওষুধের দোকান, বিভিন্ন কসমেটিকস এর দোকানে বা অনলাইনে প্যাকেটজাত অ্যালোভেরা জেল কিনতে পারেন।
অ্যালোভেরা জেল কেনার সময় মনে রাখবেন যে, এতে ল্যাভেন্ডার বা অন্যান্য ভেষজ, ঘন করার এজেন্ট ইত্যাদি যুক্ত আছে কি না। কারণ এর মধ্যে থাকা কিছু উপাদান আপনার চুলের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। তাই যতটা সম্ভব কম যোগ করা উপাদান সহ একটি জেল খুঁজে বের করার চেষ্টা করুন।
চুলে কেন অ্যালোভেরা ব্যবহার করবেন ?
অ্যালোভেরা জেল এর অসংখ্য উপকারী বৈশিষ্ট্যে রয়েছে। এই ভেষজ উদ্ভিদটি চুলের নানা সমস্যা সমাধানে চমৎকারভাবে কাজ করে। যার কারণে যুগ যুগ ধরে সবাই এটির ব্যাপক ব্যবহার করে আসছে। নানা ঔষধি গুণসম্পন্ন এই অ্যালোভেরা চুলে আপনি কেন ব্যবহার করবেন আসুন জেনে নেই –

ময়েশ্চারাইজিং করতে
অ্যালোভেরাতে হাইড্রেটিং গুণসম্পন্ন বৈশিষ্ট্য আছে। এটি ব্যবহার করলে আপনার মাথার স্ক্যাল্পের শুষ্কতা দূর হবে। এটি খুশকির বিরুদ্ধে লড়াই করতে সাহায্য করে। এটি আপনার চুলকে ভেতর থেকে মসৃণ এবং চকচকে করে তোলে।
চুলের বৃদ্ধিকে উৎসাহিত করে
অ্যালোভেরাতে উপস্থিত প্রোটিওলাইটিক এনজাইমগুলি মাথার ত্বকের মৃত কোষগুলিকে মেরামত করতে সাহায্য করে এবং চুলের বৃদ্ধিকে উৎসাহিত করে। এটি চুল পড়া কমাতেও সাহায্য করে।
পিএইচ ভারসাম্য রাখে
অ্যালোভেরায় আপনার চুলের প্রাকৃতিক pH-এর সমান pH স্তর রয়েছে। এটিতে সামান্য অম্লীয় pH 4.5-5.5 বিদ্যমান রয়েছে। এটি আপনার চুলের স্বাস্থ্য এবং শক্তি বজায় রাখতে সাহায্য করে।
চুলের অবস্থা
অ্যালোভেরা প্রাকৃতিক কন্ডিশনার হিসেবে কাজ করে এবং আপনার চুলকে মসৃণ ও চকচকে রাখে। এটি চুলের উজ্জ্বলতা বাড়ায় এবং সেইসাথে ঝরঝরে চুলকে নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে।
মাথার ত্বককে প্রশমিত করে
অ্যালোভেরার রয়েছে শীতল বৈশিষ্ট্য। যেটা মাথার ত্বককে প্রশমিত করতে পারে। চুলকানি এবং প্রদাহ কমাতে পারে। এছাড়াও চুলে অ্যালোভেরা ব্যবহার করলে চুলের সর্বাধিক স্বাস্থ্য বজায় থাকে। যার কারণে সকলের চুলে অ্যালোভেরা ব্যবহার করা উচিত।
অ্যালোভেরা জেল কীভাবে তৈরি করবেন
অ্যালোভেরা পাতা থেকে অ্যালোভেরা জেল তৈরি করা খুবই সহজ। আসুন জেনে নেই কীভাবে খুব সহজেই এলোভেরা জেল তৈরি করবেন –
- প্রথমেই একটি অ্যালোভেরা পাতা 8 লম্বা অংশে কেটে নিন।
- এবার প্রান্তটি কেটে ফেলুন। নিশ্চিত করুন যে আপনি ঠিক প্রান্তটি পেয়েছেন কারণ পাতা থেকে জেল বের করা কঠিন হয়।
- ত্বকের খোসা ছাড়ানোর জন্য পাতার মাঝখানে একটি লম্বা, দৈর্ঘ্যের দিকে চিরা তৈরি করুন।
- আপনার ছুরিটি ছিদ্রের নিচে রাখুন এবং এটিকে পাতার দৈর্ঘ্য বরাবর স্লাইড করুন যাতে পাতার ভেতরের জেলটি টেনে আনতে সুবিধা হয়। যতটা সম্ভব জেল পেতে পাতার ত্বকের কাছাকাছি থাকা নিশ্চিত করুন।
- এবার চামচের সাহায্যে সাবধানে জেল বের করে একটি পাত্রে সংগ্রহ করুন। পাতার হলুদ অংশ ফেলে দিন কারণ এতে টক্সিন রয়েছে।
- কয়েক ফোঁটা জাম্বুরা বীজের নির্যাস, ভিটামিন সি পাউডার, ভিটামিন ই তেল বা কিছু এসেনশিয়াল অয়েল যোগ করুন যাতে জেলটি দীর্ঘ সময়ের জন্য সংরক্ষণ করা যায়।
- একটি উচ্চ গতির ব্লেন্ডারে সব উপাদান নিয়ে 30 সেকেন্ডের জন্য মিশ্রণটি ব্লেন্ড করুন।
- একটি পরিষ্কার স্টোরেজ পাত্রে জেলটি ঢেলে ফ্রিজে রাখুন।
- এটি প্রায় এক সপ্তাহ ফ্রিজে তাজা থাকবে। এবং আপনার চুলে নিশ্চিন্তে ব্যবহার করুন।

চুলে কীভাবে অ্যালোভেরা ব্যবহার করবেন ?
চুলে নানা উপায়ে অ্যালোভেরা ব্যবহার করা যায়। তবে এটি একটি সহজ হেয়ারপ্যাক হিসেবে আপনার চুলে ব্যবহার করতে পারেন। এটি চুলের বৃদ্ধিতে সাহায্য করবে এবং আপনার চুলকে করবে অনেক নরম। এছাড়াও চুলের চকচকে ভাব এনে দিয়ে চুলকে আরো উজ্জ্বল করবে।
অ্যালোভেরা হেয়ার প্যাকের জন্য আপনার প্রয়োজন হবে :
- 5 চামচ অ্যালোভেরা জেল।
- 3 টেবিল চামচ নারকেল তেল।
- 2 টেবিল চামচ মধু।
প্রস্তুতপ্রণালী ও ব্যবহার
সব উপকরণ একসঙ্গে মিশিয়ে একটি মসৃণ মিশ্রণ তৈরি করুন। এবার এই মিশ্রণটি আপনার মাথার ত্বকে ভালোভাবে ম্যাসাজ করুন এবং তারপরে এটি আপনার পুরো চুলের ডগায় দিন। এরপর আপনার সমস্ত চুলে এই মিশ্রণ লাগিয়ে একটি শাওয়ার ক্যাপ দিয়ে ঢেকে রাখুন। তারপর প্রায় 25 মিনিট অপেক্ষা করুন। এরপর ঠান্ডা জল এবং শ্যাম্পু দিয়ে আপনার চুল ধুয়ে ফেলুন এবং শেষে কন্ডিশনার দিন। সপ্তাহে একবার এই অ্যালোভেরা প্যাক লাগাতে পারেন।
চুলের যত্নে অ্যালোভেরার নানা উপকারিতা
অ্যালোভেরা তার নিরাময় বৈশিষ্ট্যের জন্য শতাব্দী ধরে ব্যবহার করা হয়েছে।এটি আসলে আপনার চুলকে শক্তিশালী করতে পারে এবং আপনার মাথার ত্বককে স্বাস্থ্যকর করে তোলে। এছাড়াও অ্যালোভেরার রয়েছে নানান উপকারী গুন। আসুন সেগুলা সম্পর্কে জেনে নেই –

- খুশকির কারণে মাথার ত্বকের প্রদাহ সৃষ্টি হয় যা অ্যালোভেরা সমাধান করতে সাহায্য করে।
- অ্যালোভেরা চুলের ফলিকলকে দক্ষতার সাথে পরিষ্কার করে, অতিরিক্ত সিবাম দূর করে যা আপনার চুলকে তৈলাক্ত করে তোলে এবং চর্বিযুক্ত চেহারা দেয়।
- অ্যালোভেরাতে রয়েছে ভিটামিন এ, সি এবং ই । এই তিনটি ভিটামিনই স্বাস্থ্যকর চুলের কোষের বৃদ্ধি করে এবং চুলকে চকচকে করতে উৎসাহিত করে।
- অ্যালোভেরা জেলে ভিটামিন বি-১২ এবং ফলিক অ্যাসিডও রয়েছে। যা আপনার চুলের পুষ্টি জোগানে সাহায্য করে।
- অ্যালোভেরা আপনার চুলের সূর্যের ক্ষতি মেরামত করতে সাহায্য করে।
- অ্যালোভেরার জুস আপনার শরীরের pH লেভেল ঠিক রাখে।
- অ্যালোভেরা আপনার চুল দ্রুত বাড়তে সাহায্য করে।
- অ্যালোভেরা আপনার চুলকে সিল্কি, চকচকে এবং মসৃণ করে তোলে।
চুলের যত্ন নিতে অ্যালোভেরা জেল ব্যবহার অনেক পুরোনো একটি উপায়। এটি ব্যবহার করার ফলে আপনার চুলকে প্রাকৃতিকভাবে স্বাস্থ্যবান করে তোলে। এর নানাবিধ ব্যবহার ইতোমধ্যেই নির্দেশিকায় জেনেছেন। আশা করি আপনি উপকৃত হবেন।