সুন্দর কে না হতে চায়! সুন্দর হতে চাওয়াটা দোষের কিছুও নয়; বরং স্বাভাবিক।
কিন্তু এখানে আমার দুটো প্রশ্ন আছে-
- আপনার কাছে সৌন্দর্যের সংজ্ঞা কী?
- ত্বকের রং ফর্সা হওয়াটাই কি সৌন্দর্যের প্রধান শর্ত?
প্রথম প্রশ্নের ব্যাপারে আপনি কিভাবে ভাবেন তা আপনার উপরই ছেড়ে দিলাম। কিন্তু দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর আমাদের প্রায় সবার কাছেই এক; আর তা হবে নাই বা কেন! বিভিন্ন ফেয়ারনেস ক্রিমের লোভনীয় সব বিজ্ঞাপন যে আমাদের এটাই শিখিয়ে আসছে বছরের পর বছর!
এতে করে সহজ-সরল আপনি তাদের সস্তা মার্কেটিং স্ট্র্যাটেজির ফাঁদে পা দিয়ে তাদেরকে লাভবান করলেও নিজের জন্য যে খাল কেটে কুমির আনছেন- তা নিয়ে কি কখনো ভেবে দেখেছেন?
এই কঠিন লেখাগুলো পড়ে হয়তো আপনার সহজ-সরল মনে প্রশ্ন জাগতেই পারে, আমার অমুক আত্মীয় তো তমুক ক্রিম ব্যবহার করে এক্কেবারে ধবধবে ফর্সা হয়ে গেছে! তাই আমিও কিনেছি! এতে সমস্যার কী আছে? সমস্যার কিছু আছে কিনা আজকে এই পোস্টে আমরা সেটাই জানার চেষ্টা করব। বিস্তারিত জানতে শেষ পর্যন্ত আমাদের সাথেই থাকুন।
ফর্সা করার ক্রিম কি ত্বকের জন্য ক্ষতিকর?
বাজারের ত্বক ফর্সা করার ক্রিমগুলোর আমাদের ত্বকের উপর কোনো ক্ষতিকর প্রভাব আছে কিনা তা জানার জন্য চলুন দেখে নিই এসব ফেয়ারনেস ক্রিমের উপাদানগুলো কী কী। আমাদের উপমহাদেশে প্রচলিত ত্বক ফর্সাকারী ক্রিমগুলোর প্রধান উপাদানগুলো হলো-

- হাইড্রোকুইনোন (Hydroquinone)
- স্টেরয়েডস (Steroids)
- পারদ (Mercury)
এগুলো সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা শুরু করার আগে বলে রাখি, ক্রিমের প্যাকেটের গায়ে প্রায় সময়ই ক্রিমে ব্যবহৃত সব উপাদানের নাম দেয়া থাকে না। কিছু কিছু ক্ষতিকারক উপাদানের নাম প্রায়ই আড়াল করে রাখা হয়। আমাদের অনেকের ধারণা, এই বিচারে হারবাল বা আয়ুর্বেদিক ত্বক ফর্সাকারী ক্রিমগুলো আমাদের ত্বকের জন্য নিরাপদ। কারণ এতে কোনো কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয় না।
এই ধারণাটি সঠিক নয়। এসব হারবাল বা আয়ুর্বেদিক ক্রিমেও থাকে অনেক কেমিক্যাল বেইজড প্রিজারভেটিভ যা আপনার ত্বকে এলার্জির মতো সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। যাই হোক, এই ব্যাপারে সামনে বিস্তারিত আলোচনা আসবে। আমরা আমাদের প্রসঙ্গে ফিরে আসি।
এখন আমরা জানব উপরের তিনটি উপাদানের সংক্ষিপ্ত পরিচয়-
হাইড্রোকুইনোন (Hydroquinone)
বাজারের বিখ্যাত কিছু ফেয়ারনেস ক্রিমের প্রধান উপাদান এই হাইড্রোকুইনোন। এটি খুব কার্যকরী একটি ব্লিচিং এজেন্ট। নিয়মিত ব্যবহার করতে থাকলে এটি ধীরে ধীরে আপনার ত্বককে পাতলা করে দেয়। ফলে ত্বকের সেন্সিটিভিটি বেড়ে যায়; এমনকি টেনডন, লিগামেন্ট ও ত্বকের স্থায়ী ক্ষতি করতে পারে এটি।
স্টেরয়েডস (Steroids)
এটাও ফেয়ারনেস ক্রিমগুলোর প্রধান উপাদানগুলোর একটি। এটি আপনার দেহের ন্যাচারাল স্টেরয়েড প্রোডাকশনকে ক্ষতিগ্রস্থ করে। এছাড়াও এটি দেহের হরমোন নিঃসরণে জটিলতা সৃষ্টি করে সিস্টিক ব্রণ বা এলার্জির মতো রোগ তৈরি করতে পারে। এমনকি অনেক সময় দেখা যায়, কেউ স্টেরয়েড ব্যবহার করে ফর্সা হওয়ার পর ব্যবহার করা ছেড়ে দিয়ে আগের চেয়ে আরো কালো হয়ে গিয়েছে!
পারদ (Mercury)
কখনো থার্মোমিটার ভেঙেছেন? ভেঙে থাকলে নিশ্চয়ই ধূসর ছোট ছোট বলের মতো পারদ বা মার্কারি দেখে থাকার কথা। বাজারের অধিকাংশ ক্রিমেই এটি ব্যবহার করা হয়ে থাকে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, যেসব পণ্যে মার্কারি আছে সেগুলো আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং আফ্রিকার অনেক দেশে মার্কারিযুক্ত পণ্য বিক্রি করা নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এই পারদ একটা মাত্রার উপরে আপনার শরীরে প্রবেশ করলে এটি আপনার লিভার ও কিডনীকে অনায়াসেই নষ্ট করে দিতে পারে।
ফেয়ারনেস ক্রীম আপনার শরীরে কী কী ক্ষতি করে?
চলুন জেনে নিব এসব ফেয়ারনেস ক্রীম আপনার শরীরে কী কী ক্ষতি করতে পারে।
চুলকানি
ত্বক ফর্সাকারী ক্রিম আপনার ত্বকে প্রাকৃতিকভাবে তৈরি হওয়া তেল শুষে নেয়। ফলে শুষ্ক ত্বক চুলকানি সৃষ্টি করে আপনার সংবেদনশীল ত্বককে স্থায়ীভাবে নষ্ট করে দিতে পারে। এছাড়াও হাইড্রোকুইনোনের প্রভাবে ত্বকে কালো ছোপ, অস্বাভাবিক চুলকানি এবং জ্বালাপোড়া তৈরি হতে পারে।
রোদে জ্বালাপোড়া
এসব ক্রিম আপনার ত্বকের লেয়ারকে স্বাভাবিকের চেয়ে পাতলা করে দেয়। ফলে এটি সূর্যের অতিবেগুনী রশ্মির কাছে সহজেই ঘায়েল হয়ে যায়। ফলে অল্পবয়সেই মুখে বলিরেখা পড়ে যাওয়া থেকে শুরু করে স্কিন ক্যান্সার পর্যন্ত হতে পারে।
ত্বকের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস
ত্বক ফর্সাকারী ক্রিম আপনার ত্বকের রোগ প্রতিরোধকারী কোষগুলোকে ক্ষতিগ্রস্থ করে। ফলে ব্যকটেরিয়াল বা ফাঙ্গাল সংক্রমনের সম্ভাবনা বহুগুণ বেড়ে যায়।
রোসেসিয়া বা লালচে ফুস্কুড়ি
পাতলা ত্বকে নিয়মিত এসব ক্রিম ব্যবহার করতে থাকলে এটি ত্বকের রক্তনালীগুলোকে দৃশ্যমান করে তোলে। পাশাপাশি এর কারণে এক ধরণের লালচে ফুস্কুড়িও দেখা দিতে পারে।
কিডনী ও স্নায়বিক জটিলতা
আমরা আগেই দেখে এসেছি যে এসব ক্রিমের অধিকাংশতেই পারদ থাকে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এই পারদকে আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর ঘোষণা করেছে। এটি আপনার কিডনী ড্যামেজ করে দেয়ার পাশাপাশি নানান স্নায়বিক রোগ সৃষ্টি করতে পারে।
ত্বকের রং নষ্ট করে দেয়া
এটি ত্বক ফর্সাকারী ক্রিমগুলোর অন্যতম প্রধান সমস্যা। এটি আপনার ত্বককে ফর্সা করার নামে মূলত ফ্যাকাশে করে দেয়। ফলে আপনি হারান আপনার ত্বকের স্বাভাবিক রং। চূড়ান্ত পর্যায়ে এটি স্কিন ক্যান্সারও তৈরি করতে পারে।

ত্বকের চামড়া শক্ত হয়ে যাওয়া
এটি একাধিক গবেষণা থেকে প্রমাণিত। এসব কেমিক্যাল ক্রিম নিয়মিত ব্যবহারে ত্বক হারায় তার স্বাভাবিক সৌন্দর্য। ত্বকের চামড়া শক্ত হয়ে যাওয়া, স্ট্রেচ মার্ক পড়া সহ নানাধরণের সমস্যা তৈরি করে এটি।
মুখে ভাঁজ বা বলিরেখা পড়া
এসব ক্রিম ব্যবহারে অল্প বয়সেই আপনার ত্বকে বয়সের ছাপ পড়ে যেতে পারে।
হাইপারপিগমেন্টেশন
২% এর বেশি হাইড্রোকুইনোন যেসব ক্রিমে থাকে সেগুলো যদি টানা তিনমাস ব্যবহার করা হয় তাহলে আপনার ত্বক ফর্সা হওয়ার পরিবর্তে হিতে বিপরীত হতে পারে। মুখ এবং সারা শরীরেও হাইপরপিগমেন্টেশন নামক রোগ হওয়ার আশঙ্কা।
স্কিন ক্যান্সারের ঝুঁকি
অনেক ত্বক ফর্সাকারী ক্রিমেই অনিয়ন্ত্রিতভাবে স্টেরয়েড এবং Tretinoin নামক রাসায়নিক ব্যবহার করা হয় যা কার্সেনোজেনিক; অর্থাৎ ক্যান্সার সৃষ্টিকারী। তাই এসব ক্রিম ব্যবহারে অনেকাংশেই বেড়ে যায় স্কিন ক্যান্সারের ঝুঁকি।
কমে যায় ক্ষত সারানোর ক্ষমতা
আমাদের ত্বকের রয়েছে তার নিজস্ব ক্ষত নিরাময় ব্যবস্থা। নিম্নোক্ত চার ধাপে এটি সম্পন্ন হয়-
- Haemostasis অর্থাৎ রক্ত জমাট বাঁধা
- Inflammation বা প্রদাহ
- Proliferation
- Maturation
দীর্ঘদিন এসব ক্ষতিকর কেমিক্যালযুক্ত ক্রিম ব্যবহার করলে আপনার ত্বকের এই সিস্টেমেটিক ক্ষত সারানোর প্রক্রিয়াটি ক্ষতিগ্রস্থ হয়।
আরো বিবিধ সমস্যা
British Journal of Dermatology-তে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী ব্রণ, ডার্মাটাইটিস বা একজিমার মতো ত্বকের রোগে যদি ফেয়ারনেস ক্রিম ব্যবহার করা হয় তাহলে এসব রোগ আরো বেড়ে যায়। এছাড়াও আরো অনেক দীর্ঘমেয়াদী সমস্যার সম্মুখীন হতে পারেন এসব ক্ষতিকর কেমিক্যালযুক্ত ক্রিম ব্যবহার করে।
এতকিছু জানার পরও কি আপনি এসব ত্বক ফর্সাকারী ক্রিম ব্যবহার করার কথা ভাবতে পারেন? যেকোনো বিবেকবান মানুষ নিশ্চয়ই এটি ভাববে না। নিজেকে ভালোবাসুন। এই মানসিকতা থেকে বের হয়ে আসুন যে সৌন্দর্য শুধুমাত্র ফর্সা হতে পারার মধ্যেই নিহিত। নিজের মানসিকতাকে পরিবর্তন করুন, দৃষ্টিভঙ্গি বদলান। আপনি যেমন, তেমনই সুন্দর; এখানে কোনো হীনমন্যতাকে স্থান দিবেন না।
শেষ পর্যন্ত পড়ার জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ। আশা করি এর থেকে আপনারা উপকৃত হতে পারবেন। আপনাদের যেকোনো মতামত বা জিজ্ঞাসা থাকলে আমাদের জানান। আপনাদের পছন্দের বিষয়ে এরকম আরো লেখা পেতে আমাদের সাথেই থাকুন।